পরিবহন সংকটে দুর্ভোগ

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৮ জুলাই ২০১৫ : গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি, বাড়ি যাবো। তবে রাস্তায় তো গাড়িই কম। প্রায় ৩ ঘণ্টা হয়ে গেলো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোন গাড়ি আসছে না। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে কয়েক লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ায় বদলে গেছে রাজধানীর চিত্র। প্রচণ্ড যানজটের শহর ঢাকা এখন অনেকটাই ফাঁকা।শনিবার ঈদের দিন দুপুরে বনানী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুর কাপাসিয়ার বাসিন্দা মো. আব্দুর রশিদ।বাসস্ট্যান্ডে শুধু তিনিই নন তার সঙ্গে ঢাকার আশে পাশের জেলার যাত্রীরাও এভাবেই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু যাওয়ার মতো কোনো গাড়ি পাচ্ছেন না।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার আশে-পাশের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় যে বাসগুলো চলাচল করে এবং টাউন সার্ভিসগুলোর অধিকাংশ বাস যাত্রী নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রিজার্ভ চলে গেছে। যে কারণে রাজধানীতে টাউন সার্ভিস বাসগুলো কমে গেছে। ফলে চাঁদরাত পর্যন্ত যেসব মানুষ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন, তারা পড়েছেন বিড়ম্বনায়। ঈদের দিনেও তারা বাড়ি যেতে পারছেন না।আব্দুর রশিদ বলেন, তিনি ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। হাতে কাজ থাকায় ঈদের দিন সকালে যাবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু সকাল থেকে গাড়ি বিরম্ভনার পড়ে বাড়ি যাওয়া দুপুর পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। প্রতিদিন মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকা, সদরঘাট, গাবতলী রুটে যে সব টাউন সার্ভিস চলাচল করে সেগুলোর আজ একেবারেই কম। অন্যদিকে গাজীপুর থেকে সদর ঘাট, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী থেকে ঢাকার বাসগুলো নেই বললেও চলে। এই অবস্থায় এসব জেলায় যাত্রীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা সিগন্যাল পয়েন্টে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট (এসআই) বিমল চন্দ্র সাহা বলেন, রাজধানীতে গণপরিবহনের সংখ্যা খুবই কম। দীর্ঘ সময় পর পর একটি দুটো গণপরিবহন আসতে দেখা যাচ্ছে।নরসিংদী যাওয়ার উদ্দেশে রাজধানীর বনানী-কাকলীতে বাসের জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন আনোয়ার হোসেন। সঙ্গে তার ছোট ভাই বাদল। তিনি বলেন, এই বৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ধরেই তো দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু বাস আসছে না। ঘণ্টা খানেক আগে একটি বাস আসলেও সেটি এখানে দাঁড়ায়নি। পরিবহন সংকট আর বৃষ্টিতে অনেকটা দুর্ভোগেই আছি।

তবে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টি উপেক্ষা করেও অনেকেই ঈদের দিনে ঘর থেকে বের হয়েছেন। কিন্তু তারা পড়েছেন গণপরিবহন সংকটে।মগবাজার মোড়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা রাজিব ও মিথিলা বলেন, উত্তরায় এক বন্ধুর বাসায় যাবো বলে বাসা থেকে বের হয়েছি কিন্তু বাস পাচ্ছি না। সিএনজি চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছে। এই অবস্থায় বাসা থেকে বের হয়ে আমরা বিপাকেই পড়েছি। শুক্রবার সকাল থেকেই রাজধানীর পল্টন, রমনা, কাকরাইল,মিন্টো রোড, শাহবাগ,রাজারবাগ, পান্থপথ, এলিফ্যান্ট রোড ও উত্তরা এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। শনিবার ঈদের দিন ভর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।

রাজধানীর অভিজাত বিপণীবিতানগুলোর সামনেও চোখে পড়েনি চিরচেনা ভিড়। রাস্তার পাশের ছোট বিপণীবিতানগুলোতে লোকজন নেই বললেই চলে। সড়কে দেখা যায়নি বাসের জন্য সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা।জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টো দিকের চায়ের দোকানি আলম বলেন, ঢাকা ফাঁকা হইয়া গেসে মামা। আগে দুপুরের সময় প্রেসক্লাবের সামনে অনেক গাড়ি জ্যামে বইসা থাকত। আইজ কিসু নাই।ঢাকা মহানগর পুলিশের কনস্টেবল মো.কামরুল আলম হৃদয় শনিবার রাজধানীর কাকরাইল, প্রেসক্লাব, বেইলিরোড এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন।তিনি বলেন, অন্যান্য দিনের মতো ঢাকায় মানুষের ভিড় নেই। রাস্তাগুলো অনেকটাই ফাঁকা। পথে চলাচল করতে কোনো ধরনের যানজটে পড়তে হচ্ছে না কাউকে।বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবদুল জলিল বলেন, ঈদের আগে ঢাকা ফাঁকা থাকে বলে কেনাকাটা করতে বের হয়েছি। কেনাকাটা শেষে খুব সহজেই মিরপুর ফিরে যেতে পারব।

শনিবার সকাল ১০টার দিকে প্রাইভেট কারে উত্তরা থেকে যাত্রা করে গুলশান-২ নম্বর মোড়ে আসতে তার ১৭ মিনিট সময় লেগেছে, যেখানে অন্য সময় এই রাস্তা পাড়ি দিতে ঘণ্টাখানেক লেগে যায়।শনিবার রাজধানীর সড়কগুলোতে গণপরিবহনও ছিল তুলনামূলক কম।ট্রাফিক কন্ট্রোলরুমের অপারেটর আবদুল মালেক জানান, শুক্রবার থেকেই ঢাকার কোথাও যানজটের খবর পাননি তারা। অন্যান্য দিনের চেয়ে রাস্তায় লোকজন অনেকটাই কম।সকালে রামপুরা থেকে নতুন বাজার, গুলশান, মহাখালী, ফার্মগেইট, শ্যামলী,কল্যাণপুর, গাবতলী, নিউ মার্কেট এলাকা ঘুরে কোথাও যানজট চোখে পড়েনি।ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িগুলোকে এক মিনিটও অপেক্ষা করতে হচ্ছে না বলে জানান তিনি। ফয়সাল বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেও যানজটের কারণে শাহবাগ, নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, গুলিস্তান, মহাখালী, মগবাজার এলাকায় গণপরিবহনগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর শনিবার একেবারেই ফাঁকা।প্রতিবছর ঈদে গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলেও এবার ঢাকায় ঈদ করছেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ইনাম আহমেদ।তিনি বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের যে চিত্র দেখা গেছে তা খুবই উপভোগ্য। ঈদে ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায়-এমন কথা পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনে দেখলেও এবার নিজেই উপভোগ করছি।

রাজধানী ঢাকায় একদিন আগেও যানজট, বৃষ্টির জলাবদ্ধতায় সৃষ্ট জনদুর্ভোগের যে চিত্র ছিল তা রাতারাতি বদলে গেছে।একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এই শহরের দুই প্রান্তে যদি দুই কাজ থাকে, তাহলে কখনই একদিনে করা যায় না। আজ সকালে সায়েদাবাদ গিয়ে বোনকে গাড়িতে তুলে দিয়েছি। আরেক বোনকে টঙ্গী গিয়ে দেখে এসেছি। বেলা ১টার দিকে টঙ্গী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফেরা আজাদ বলেন, দেখেন এখনো দুপুরই হয়নি। আরও কত কাজ করা যাবে।

এক মাস রোজার পর শনিবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করবে বাংলাদেশের মানুষ। এই ঈদ সামনে রেখে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেছেন বলে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, শুক্রবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা নগরীর বিভিন্ন স্ট্যান্ডগামী মানুষের গণপরিবহনের আশায় দাঁড়িয়ে আছে।এর মধ্যে রাজধানীর কাকরাইল, শান্তিনগর, মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা, গুলিস্তান, নয়া পল্টন, যাত্রাবাড়ী, শাহবাগ, ফার্মগেট, পান্থপথ, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান, ধানমন্ডি এলাকার রাস্তার বাসস্টপগুলোতে গণপরিহনের আশায় মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেককে বাস না পেয়ে পায়ে হেঁটেই চলতে দেখা গেছে।এদিকে বর্ধিত জনসংখ্যা তথা যাত্রী চাহিদা মেটাতে গণপরিবহন বৃদ্ধি না পেয়ে হু হু করে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি। ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ঈদের ছুটিতেও রাজপথে যানজট অনিবার্য হয়ে উঠছে।এবিষয়ে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা ওসমান আলী বলেন, প্রাইভেট গাড়ির আধিক্য রাজপথে যানজট সৃষ্টির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ালেও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৫০টি। এ সময়ে মাত্র ১৬টি মিনিবাসের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালজুড়ে রাজধানীতে প্রাইভেট কারের রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছিল ১২ হাজার ৯৭২টি অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৩৬টি করে। এ সময় মিনিবাস রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়েছে মাত্র ১৩৫টি। রাজধানীতে বর্তমানে ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি আছে ২ লাখ ৮ হাজারের বেশি। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। কিন্তু বাড়তি যাত্রী চাহিদার বিপরীতে গণপরিবহন না বেড়ে বরং হ্রাস পাচ্ছে।তিনি আরো বলেন, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চাঁদাবাজি-হয়রানির কারণেও পরিবহন ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে। রাজধানীর সড়কগুলোয় অনুমোদিত ৯৮টি পরিবহন কোম্পানির মধ্যে পর্যায়ক্রমে ২৪টি কোম্পানিই তাদের সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে। বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় গত কয়েক বছরে নগরীর বিভিন্ন রুটে প্রায় ৩ হাজার বাস-মিনিবাস বন্ধ হয়ে গেছে। রাজধানীতে চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন বিশেষত বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় সাধারণ যাত্রীদের হয়রানির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।গণপরিবহন সংকটের কারণে পুরো রমজান জুড়ে রাজধানীর শাহবাগ, বাংলামটর, ফার্মগেট, মহাখালী, মতিঝিলসহ বিভিন্ন বাস স্টপগুলোতে ছিল যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়।এদিকে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির নেতা এনায়েত উল্লাহ বলেন, রাজধানীতে গণপরিবহন হ্রাস পাওয়ার একটি কারণ, পুরনো যানবাহন অকেজো হওয়ার পর নতুন যানবাহন রাস্তায় না নামানো। তাছাড়া হরতালে ও রাজনৈতিক সহিংসতায় নির্বিচারে বাস ভাঙচুর ও পোড়ানোর ফলেও রাজধানী থেকে অনেক যান উধাও হয়ে গেছে। অন্যদিকে গণপরিবহনের বেহাল দশার কারণে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে।এ ব্যাপারে শাহবাগ মোড়ে কথা হয় এনজিও কর্মী রহমত উল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, রাজধানীর গণপরিবহনে অনিয়মই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি নতুন রুট এবং কিছু নতুন বাস চালু হলেও অনেক পরিবহন রাস্তা থেকে উঠে গেছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের এ নগরীতে এখন অনেক রুটেই পর্যাপ্ত পাবলিক বাস নেই।রাজধানীর জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে অন্তত সাড়ে ৭ হাজার বাস-মিনিবাসের প্রয়োজন। কিন্তু রাস্তায় চলাচল করছে মাত্র সোয়া ৪ হাজার বাস-মিনিবাস। এসব কারণে সাধারণ মানুষের ভোড়ান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।রাজধানীর গণপরিবহন কম থাকায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিম্নবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তদের পক্ষে রাজধানীতে স্বল্প খরচে চলাচলের কোনো উপায় নেই বললেই চলে। স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের আশা তো দুরাশা। পরিবহন অব্যবস্থাপনা রাজধানীবাসীর ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও তা দেখার কোনো কর্তৃপক্ষ দেশে নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। দুই কোটি মানুষের স্বার্থে এ অব্যবস্থার দ্রুত অবসান চায় নগরবাসী।