দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৬ জুলাই ২০১৫: সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা প্রত্যাশা করার পাশাপাশি অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তিনি বলেন, হাতে কলম থাকলে, সে কলমের অপব্যবহার হলে, একদিন না একদিন সেটা প্রকাশ পায়৷বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অস্বচ্ছল সাংবাদিকদের সহায়তা ভাতা প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন৷ প্রধানমন্ত্রী ১৭৭ জন অস্বচ্ছল, দায়িত্বপালনকালে আহত ও নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন৷ যাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা থেকে দুই লাখ টাকার সহায়তা দেওয়া হয়৷ শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশে বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক সাংবাদিকতার চর্চা দেখতে চাই৷ স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তিবর্গ সমাজে অপসাংবাদিকতার চর্চা করছে৷ আপনাদের পেশার স্বার্থে এসব ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে আপনাদেরই সোচ্চার হতে হবে৷
তিনি বলেন, সাংবাদিকতার একটা এথিক্স থাকতে হবে, নিয়ম নীতি থাকতে হবে, প্রত্যেকটারই একটা গঠনমূলক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে৷ আমি সব সময় চাইবো মিডিয়ায় যেন এ ধরনের নিউজ না যায় যেটা চরিত্র হনন করে, দেশ বা মানুষের ক্ষতি করে৷তথ্যভিত্তিক সাংবাদিকতা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটা মানুষকে যদি ভুল তথ্য দিয়ে তার চরিত্র হনন করা হয়, পরবর্তীতে যতই রিজয়েন্ডার দেওয়া হোক না কেন ক্ষতি যা হবার তা কিন্তু হয়ে যায়৷ এই ক্ষতি কিন্তু আর পূরণ হয় না৷ এটা কোনো সাংবাদিকতা নয়, বা সমালোচনা হিসেবেও যোগ্য সমালোচনা না৷ এ বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে৷গঠনমূলক সমালোচনার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমালোচনা যারা করবেন করেন, আমার কোনো আপত্তি নেই, শুধু একটা অনুরোধ থাকবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয় অথবা শত্রুর মুখে যেন কথার যোগান দেওয়া না হয় সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন৷তিনি বলেন, সমালোচনা যত হোক আমার আপত্তি নেই৷ সমালোকদের কখনো আমি ভয় পাই না বা এ নিয়ে আমি চিন্তিত না৷ বরং সমালোচনা বেশি হলে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়, কোন কাজটা ভালো হচ্ছে কোন কাজটা মন্দ হচ্ছে তা দেখার৷ তবে সমালোচনা যেন গঠনমূলক হয়৷ সমালোচনা যেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হয়৷ সংবাদপত্র মালিকদের অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অষ্টম ওয়েজ বোর্ড চালু করা হয়েছে৷ যেসব পত্রিকা ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করেছে, তাদের বিজ্ঞাপনের হার দ্বিগুণ করা হয়েছে৷ যারা এখনও এটি বাস্তবায়ন করেনি, তাদের বিষয়টি সরকার নিবিড়ভাবে মনিটর করছে৷ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে যারা ব্যর্থ হবে তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা সীমিত করে দেওয়া হবে৷সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট গঠনে সরকারের পাশাপাশি মালিক, সাংবাদিক ও দানশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সিড মানি দেওয়া হবে৷ এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে৷
সমপ্রচার নীতিমালা ২০১৪ প্রণয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এ নীতিমালার আওতায় সমপ্রচার কমিশন আইন প্রণয়ন করা হবে৷ যত শিগগির সম্ভব এ আইন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হবে৷
শিগগির অনলাইন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে অসংখ্য অনলাইন গণমাধ্যম চালু রয়েছে৷ বর্তমানে অনলাইন গণমাধ্যমের কোনো নীতিমালা নেই৷ এখানে অনেক সময় এমন সব ছবি, তথ্য আসে যেটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর৷ বিশেষ করে শিশুদের জন্য৷ এজন্য একটা অনলাইন নীতিমালা একান্তভাবে প্রয়োজন৷সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদসহ বিএনপি-জামায়াতের সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী৷ একই সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে বলেন তিনি৷
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেশে বস্তুনিষ্ঠ ও গঠনমূলক সাংবাদিকতা দেখতে চাই৷ স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তিবর্গ সমাজে অপসাংবাদিকতা চর্চার চেষ্টা করছে৷ পেশার স্বার্থে এসব ব্যক্তিবগের্র বিরুদ্ধে আপনাদেরই সোচ্চার হতে আহ্বান জানাচ্ছি৷সরকারের কার্যক্রম নিয়ে সাংবাদিকদের গঠনমূলক সমালোচনা করতেও আহ্বান জানান তিনি৷সমালোচনা যত হোক, আমার আপত্তি নেই৷ আমি সমালোচকদের কখনও ভয় পাই না৷ বরং সমালোচনা বেশি হলে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়; সেখান থেকে জানতে পারি কোন কাজটা ভালো হচ্ছে, আর কোন কাজটা মন্দ হচ্ছে- সেটা দেখার একটা সুযোগ হয়৷ তবে এই সমালোচনা যেন গঠনমূলক হয়৷সমালোচনা করতে গিয়ে অনেক সময় সাংবাদিকরা মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করেন বলে মন্তব্য করেন সরকার প্রধান৷এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন,এমন সমালোচনা যেন না হয়, যেটা আমার দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য ক্ষতিকারক৷সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, নাশকতা এবং আন্দোলনের নামে মানুষ পোড়ানোর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সাংবাদিকদের ভূমিকাও প্রত্যাশা করেছেন শেখ হাসিনা৷তিনি বলেন, সাংবাদিকতা এখন পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই খাতে কর্মসংস্থানও বেড়েছে৷
১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন সমপ্রচার উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা৷তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সুযোগ, সুবিধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলেন তিনি৷প্রধানমন্ত্রী এদিন অনুদান ও সহায়তা পাওয়া ১৭৭ সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের মধ্যে ৬৩ জনের হাতে চেক তুলে দেন৷ প্রতিটি সাংবাদিক ন্যূনতম ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা ও অনুদান পেয়েছেন৷২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬২৩ জন সাংবাদিককে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিয়েছে সরকার৷
সাংবাদিকদের সহায়তার জন্য স্থায়ী তহবিল গঠনে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে সরকারের পাশাপাশি সম্পদশালী গণমাধ্যম মালিক ও সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী৷সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য সরকারের নতুন উদ্যোগের কথা জানিয়ে তিনি এখন থেকে প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলেন৷আমরা অনেক সাংবাদিককে প্লট দিয়েছি৷ অনেকেই প্লট পেয়েছেন, কিন্তু প্লট নিবন্ধন করার মতো টাকা নেই৷ তাই ভবিষ্যতে আমরা ভিন্নভাবে পরিকল্পনা করছি৷ এখন আমরা নতুন যে ফ্ল্যাট তৈরি করছি ঢাকা শহরে, সেখানে আমরা হায়ার-পারচেজ (ভাড়া মূল্য হিসেবে পরিশোধ হওয়া) ভিত্তিতে যাতে দেওয়া যায় সে ধরণের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি৷খুব শিগগিরই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন তিনি৷
যেসব গণমাধ্যম সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করবে না, তাদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা সীমিত করে দেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন শেখ হাসিনা৷অনুষ্ঠানে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিজের গ্রেপ্তার হওয়ার কথাও তুলে ধরেন তিনি৷ জেলে থাকতে আমার কাছে অনেক রকম প্রস্তাব, অনেক কিছু বলা হয়েছে৷ আমার একটাই কথা ছিল- আমি নির্বাচন চাই, আমি গণতন্ত্র চাই৷বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে ওই সময় সাংবাদিকদের সাহসী ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী৷বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করতে কাজ করে যাওয়ার কথাও বলেন শেখ হাসিনা৷এসময় দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ক্রিকেট দলের সিরিজ জয়ের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখান থেকেই তো আপনারা বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশের যদি সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে, তাহলে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিতে বেশি সময় লাগার কথা না, লাগবে না৷
কাজেই সমালোচনা যারা করবেন করেন কোনো আপত্তি নেই৷ শুধু আমার একটাই অনুরোধ থাকবে এই যে অগগ্রযাত্রা এটা যেন ব্যাহত না হয়৷ আর শত্রুর মুখে কথা যেন জোগান না দেওয়া হয়৷ এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে৷ অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বক্তৃতা করেন৷ এতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এ কে এম রহমত উলস্নাহ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ও তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদ৷বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মঞ্জুরম্নল আহসান বুলবুল, মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি আলতাফ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ এবং সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদকগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷১৭৭ জনের মধ্যে ৬৩ জন সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনুদানের চেক গ্রহণ করেন৷ অবশিষ্ট চেক সাংবাদিক ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট শাখা বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পাঠানো হবে৷অসুস্থ, অস্বচছল ও আহত সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিকের পরিবারের সদস্যদের জন্য বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত নীতিমালার আওতায় গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে এ অনুদান দেয়া হয়৷এই সরকারের আমলে সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তার জন্য প্রথম গৃহীত এই ব্যবস্থায় বিগত ৪ বছরে ৬২৩ জন সাংবাদিক ও তাদের পরিবারকে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়৷