দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৯ জুলাই ২০১৫: ট্রেন বা বাসে চলাচল করে অভ্যস্ত যাত্রীদের কাছে নৌপথে যাত্রা যেন কেবলই ভীতিকর! বছরে দু-একটি নিম্নমানের কিংবা পুরনো লঞ্চের দুর্ঘটনা থেকে ছড়িয়েছে এমন ভীতি। তবে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে দিনে দিনে সবচেয়ে আরামদায়ক হিসেবেই খ্যাতি পেয়েছে নৌযান; তা হোক সরকারি ব্যবস্থাপনার স্টিমার সার্ভিস কিংবা বেসরকারি মালিকানাধীন লঞ্চ সার্ভিস। আকার, নকশা, নান্দনিকতা এমনকি নিরাপত্তার দিক থেকেও অন্য যেকোনো পরিবহনের তুলনায় আরামদায়ক পরিবহনের প্রতীক হয়ে উঠেছে বিশাল আকারের এসব লঞ্চ বা স্টিমার।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের চাপে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই হয়ে নৌযানগুলোর গন্তব্যে যাত্রার বিষয়টি বরাবরই একটা শঙ্কার কারণ হয়েছে। তদুপরি লক্কড়ঝক্কড় লঞ্চের গায়ে রঙের প্রলেপ দিয়ে নদীতে নামানোর ঘটনা সেই শঙ্কা কেবলই বাড়িয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখেই এবার সাধুবাদ পাওয়ার মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিরাপদ নৌযাত্রার বহরে এবার ঈদকে সামনে রেখে যুক্ত হয়েছে মোট ১১টি নতুন যান। ফলে এবার নৌপথের যাত্রীদের আগের তুলনায় ভোগান্তি কমে যাবে অনেকটাই।আগামী ১৪ জুলাই ঢাকা-বরিশাল রুটে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডাব্লিউটিসি) যাত্রীবাহী স্টিমার এমভি মধুমতী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই দিন এটির উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এর আগে গত ১২ জুন বেসরকারি মালিকানার আরেকটি বড় লঞ্চ ‘এমভি সুরভী-৯’ চালু হয়েছে ঢাকা-বরিশাল রুটে।
জানতে চাইলে বিআইডাব্লিউটিসির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কালের দৈনিকবার্তাকে বলেন, ‘দেশে যাত্রীবাহী নৌযানের ঐতিহ্য বলতেই টিকে আছে স্টিমার সার্ভিস। আর স্টিমার বললেই মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জরাজীর্ণ ও সেকেলে চেহারার স্টিমারগুলো। দিন পাল্টেছে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সমন্বয়ে এখন দেশেই একের পর এক তৈরি হচ্ছে নিরাপদ ও বিলাসবহুল স্টিমার। এর আগে গত বছর আমরা যাত্রীদের জন্য উপহার হিসেবে নামিয়েছিলাম এমভি বাঙালি। আর এবার ঈদে আমাদের পক্ষ থেকে তেমনি আরেক সেবামূলক উপহার হয়ে আসছে এমভি মধুমতী।’
বিআইডাব্লিউটিসি সূত্র জানায়, মধুমতির যাত্রী ধারণক্ষমতা ৭৫০ জন। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। নির্মাণ করেছে দেশের প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন। জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৭৫ দশমিক ৫০ মিটার ও প্রস্থ ১২ দশমিক ৫০ মিটার। জাহাজটিতে ভিআইপি ফ্যামিলি স্যুট চারটি (গোলাপ, শাপলা, টিউলিপ, পদ্ম)। প্রথম শ্রেণির সিঙ্গেল ফ্যামিলি স্যুট ১৮টি ও প্রথম শ্রেণির সিঙ্গেল কেবিন চারটি। প্রথম শ্রেণির ডাবল কেবিন রয়েছে ৩৪টি এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চেয়ার সিট ৪২টি। ডেকে প্রায় ৫৫০ জন যাত্রীর জায়গা হবে। জাহাজটি জাপানি শক্তিশালী দুই ইঞ্জিনচালিত।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ যাত্রী পরিবহন সংস্থার (লঞ্চ মালিক সমিতি) সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘লঞ্চ ও স্টিমার এখন আর আগের অবস্থায় নেই। অভ্যন্তরীণ রুটে এখন সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক যাত্রীবাহী নৌযানই সমুদ্রগামী বড় জাহাজের আদলে তৈরি হচ্ছে। আমরা প্রচলিত ভাষায় এগুলোকে লঞ্চ বলে অভিহিত করলেও বাস্তবে প্রতিটিই পরিপূর্ণ জাহাজ। তৈরির সময়ই যাত্রী ও নৌযানের নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঢাকা-বরিশাল রুটের বেশির ভাগ সরকারি স্টিমার ও বেসরকারি লঞ্চে প্রথম শ্রেণির কেবিনগুলো বানানো হয় বিলাসবহুল আবাসিক হোটেলের আদলে। ব্যয়বহুল ও দৃষ্টিনন্দন আসবাবপত্রে সাজানো প্রতিটি কক্ষ। প্রতিটি কেবিনের সঙ্গে রয়েছে সুবিশাল বারান্দা। এখানে বসে নদী, পানি, আকাশ আর আশপাশের মনোরম প্রকৃতি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। কক্ষের ভেতরে রয়েছে টেলিভিশন। রিভার সাইটের কেবিনের ভেতর থেকেও সহজেই দেখা যায় বাইরের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি।’
এদিকে সুরভী-৯ লঞ্চের স্বত্বাধিকারী রিয়াজুল কবির জানান, লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট এবং প্রস্থ ৫০ ফুট। অন্যান্য লঞ্চের তুলনায় এর আকার অনেক বড়। এতে সুসজ্জিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একক, দ্বৈত, ভিআইপি ও সেমি-ভিআইপি প্রায় ২০০ কক্ষ রয়েছে। লঞ্চটিতে শিশুদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে আধুনিক গেম জোনের ব্যবস্থা। দুই হাজার ৫০০ হর্স পাওয়ারের দুটি ইঞ্জিনচালিত লঞ্চটিতে প্রতিকূল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ও জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাডার, ইকো সাউন্ডার, ফ্রন্টলাইট, হাইড্রোলিক হুইল রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীদের সেবা নিশ্চিতকরণে লঞ্চটিতে ৭০-৭৫ জন কেবিন ক্রু কাজ করবেন। রয়েছে সর্বোচ্চ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা।
এ ছাড়া ঢাকা-পটুয়াখালী রুটে নেমেছে সুন্দরবন-১১ নামের আরেকটি বিলাসবহুল লঞ্চ। এটির দৈর্ঘ্য ২৩০ ফুট ও প্রস্থ ৩৫ ফুট। ছয়টি ভিআইপি কেবিন, ১১০টি প্রথম শ্রেণির কেবিন ও ২০টি ইকোনমি ক্লাসের সোফাসহ এ লঞ্চটিও সহজেই আকৃষ্ট করছে যাত্রীদের।ঈদ সামনে রেখে নামানো নতুন অন্য আটটি লঞ্চ হলো : মহারাজ-৭, প্রিন্স রাসেল-৪, জামাল-৫, মর্নিং সান-৫, ফারহান-৬, ফারহান-৫, ইয়াদ-৩ ও কাজল-৭। সব লঞ্চই ঢাকা থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন দূরপাল্লার রুটে চলাচল করবে। এসব নৌযানেও যাত্রীদের জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা।