দৈনিকবার্তা-বগুড়া, ৮ জুলাই: ভূমি অধিগ্রহন নীতিমালা অমান্য করে বগুড়ার শাজাহানপুরে ‘পল্লী জনপদ’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্পের ৩ দশমিক ৯১ একর জমির রেজিস্ট্রি দলিল সম্পন্ন করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রকল্পের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভুমি হুকুম দখল শাখার (এলএ) মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণের কথা থাকলেও তা না মেনে মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে রুরাল ডিভলোপমেন্ট একাডেমী (আরডিএ) বগুড়ার মহাপরিচালকের (ডিজি) নামে ৩০ জুন সোনালী ব্যাংক বগুড়া কর্পোরেট শাখায় এই জমি গুলোর রেজিস্ট্রি দলিল সম্পন্ন হয়।
এবং জমি মালিকদেরকে মূল্য পরিশোধ করা হয়। দলিলে রেজিস্ট্রি অফিসের নির্ধারণ করে দেওয়া মূল্যের চাইতেও বেশি দাম দেখিয়ে জমি মালিকদেরকে কম দাম দিয়ে সরকারের অন্তত ২ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে নেওয়া বিশেষ ওই প্রকল্পে লোপাটের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর লোপাট করা টাকার একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগ এবং এর একাধিক অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কতিপয় নেতা-কর্মী ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্ট্য সূত্রে জানাযায়, বসত-বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে যাতে ফসলি জমি নষ্ট না হয় সেজন্য সরকারিভাবে গ্রাম পর্যায়ে ‘পল্লী জনপদ’ নামে পরিকল্পিত বহুতল এবং অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট একনেকে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে প্রায় ৪২৪ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ওই প্রকল্পের অধীনে দেশের ৭টি বিভাগের সাতটি মহল্লায় ‘পল্লী জনপদ’ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় পল্লী উন্নয়ন একাডেমিক-আরডিএ’র সেন্টার ফর ইরিগেশন অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইউনিটিকে। প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রতিটি পল্লী জনপদে একটি বহুতল ভবনে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ২৭২টি করে ফ্ল্যাট থাকবে।
এছাড়া বায়োগ্যাস প্লান্ট, নিরাপদ পানি, সৌর বিদ্যুত এবং গবাদি পশু রাখারও ব্যবস্থা থাকবে। ২০১৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা। নির্ধারিত মূল্যের মাত্র ৩০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ যে কেউ ওই ফ্ল্যাটে বসবাসের সুযোগ পাবেন। বাকি ৭০ ভাগ অর্থ পরবর্তি ১৫ বছর মেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধেরা সুযোগ রয়েছে।রাজশাহী বিভাগের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বগুড়ায় আরডিএর অফিস থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের জামালপুর মৌজায় তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ৩ দশমিক ৭৫ একর জমি কেনার কথা থাকলেও বগুড়ায় রাস্তার জন্য কিছু বেশি জমি ধরে মোট ৪ একর জমি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আরডিএ’র কর্মকর্তারা এজন্য স্থানীয় একদল মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে জমি মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। দাম-দর ঠিক হওয়ার পর ৩০ জুন সোনালি ব্যাংকের বগুড়া কর্পোরেট শাখায় দলিল রেজিস্ট্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার জামালপুর মৌজায় যেসব জমি কেনা হয়েছে তার বেশিরভাগই বাঁশের ঝাড় ও নিচু জমি। তবে কিছু ধানি জমি এবং ভিটেও রয়েছে।
উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জামালপুর মৌজায় প্রতি শতক বাঁশঝাড়ের মূল্য ২৪ হাজার ৯৮৯ টাকা। আর প্রতি শতক ধানি জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ২৫৩ টাকা এবং ভিটার দাম ধরা হয়েছে শতক প্রতি ৫২ হাজার ৪৭৩ টাকা। অর্থাৎ ওই তিন ধরনের জমির প্রতি শতকের গড় মূল্য ৬০ হাজার টাকারও নিচে। কিন্তু আরডিএ সব ধরনের জমিই কিনেছে গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে। তবে দলিলে বেশি লেখা থাকলেও জমি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রকম অনুযায়ী প্রতি শতক জমির জন্য ৫৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা করে পেয়েছেন।
শাজাহানপুর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের নথি ঘেঁটে দেখা গেছে জামালপুর মৌজার আজিজুর রহমানের ৮ শতক ধানি জমির মূল্য দেখানো হয়েছে প্রতি শতক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা হিসেবে মোট ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা। একইভাবে সেকেন্দার নামে এক ব্যক্তির ৩২ শতক জমির বিক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তাকে প্রতি শতক জমির বিপরীতে ১ লাখ ২০ হাজার ৩১২ টাকা ৫০ পয়সা করে পরিশোধ দেখানো হয়েছে।
অথচ সেকেন্দার সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন, তিনি প্রতি শতক জমির মূল্য পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা করে। একই মহল্লার শামছুদ্দিন জানিয়েছেন তারা ৯জন শরীক মিলে মোট ১০১ শতক জমি বিক্রি করেছেন। প্রতি শতকের জন্য গড়ে তারা মাত্র ৫৫ হাজার টাকা করে পেয়েছেন।অপরদিকে দলিলে বেশি মূল্য দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর তার ভাগ পেতে শাসক দলের নেতা-কর্মীরা আরডিএ’র কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে তারা দলিল রেজিস্ট্রির দিন শাজাহানপুরের সাব রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলমকে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
অবশ্য পরে ভাগাভাগির অংশ নিয়ে সমঝোতা হওয়ার পর সাব রেজিস্ট্রারকে ওইদিন সন্ধ্যায় তার কার্যালয় থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। পরে রাতে সোনালী ব্যাংকের বগুড়া কর্পোরেট শাখায় ওই সাব রেজিস্ট্রারের উপস্থিতিতে দলিলগুলোর রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলা সাব রেজিষ্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাকে কেউ অবরুদ্ধ করেনি। অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি সন্ধ্যার আগে বের হতে পারেন নি।৩০ জুন দলিল রেজিস্ট্রি করতে জমি মালিকের সঙ্গে আসা হারুনুর রশিদ নামে এক ব্যক্তি জানান, ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা তাদের নেতাদের নামে টাকার ভাগ নিতে সেদিন ব্যাংকের ভেতরেই অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওরা টাকার জন্য আরডিএ কর্মকর্তাদের এতটাই চাপ দিচ্ছিল যে আমাদের টাকা পরিশোধ করার আগেই তাদের হাতে দাবি করা টাকা তুলে দেওয়া হয়।
এনামুল হক নামে অপর এক জমি মালিক বলেন, ‘টাকা পয়সার ভাগাভাগি নিয়ে ওই রাতে ব্যাংকের ভেতরে উত্তপ্ত এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এতে আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। পরে আমাদের পুলিশ দিয়ে বাড়ি পৌছে দেওয়া হয়েছিল।সোনালী ব্যাংক বগুড়া কর্পোরেট শাখার অ্যাসিসটেন্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) আব্দুল কুদ্দুস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ৩০ জুন আরডিএর পক্ষ থেকে মোট ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
তিনি আরো জানান, ওইদিন রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তারা ব্যাংকে অবস্থান করেছিল। সেদিন কোন হাঙ্গামা হয়েছিল কি’না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না সেরকম কিছু হয়নি কারণ ব্যাংকের ভেতরে পুলিশ ছিল। তবে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (আরডিএ) কর্মকর্তারা অর্থ লোপাটের কথা অস্বীকার করলেও বেশি দামে জমি কেনার কথা স্বীকার করেছেন। ‘পল্লী জনপদ’ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকা আরডিএ’র পরিচালক মাহমুদ হোসেন খান জানিয়েছেন, প্রকল্পের জন্য যেসব জমি কেনা হয়েছে রেজিস্ট্রি অফিস থেকে তার শতক প্রতি গড় মূল্য ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার টাকা। সেদিক থেকে আরডিএ প্রতি শতক জমি গড়ে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করে কেনার কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘মাটি ভরাটসহ প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজের ব্যয় যুক্ত করার কারণেই জমির দাম কিছুটা বেশি হয়েছে।