দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০১ জুলাই ২০১৫: “প্রথম রমজানেই বেগুণের দাম ১০০ টাকা : মওকা বুঝে অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটি অতি মুনাফালোভী বাদে অন্য সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে। বেগুনের কেজি ১০০ টাকা হওয়ার পেছনে কী যৌক্তিকতা আছে ? রমজানের দু’দিন আগে বেগুনের দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা। আর রমজান শুরু হওয়া মাত্রই তার দাম পৌছে গেল শতকের কোঠায়। তার পরেও আমাদের বেগুন খেতেই হবে! ‘রমযানে যখন বেগুনের দাম বেড়ে যায়, তখন সবাই বেগুন কেনা বন্ধ করে দিলে বেগুন ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের পায়ে সালাম করতে বাধ্য হবে। সবাই যখন বেগুনের পিছু নেয়, আমি চলি ঠিক তার উল্টা দিকে’। রমযানের দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গ তুলে ধরে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে কথা বলেছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক জনাব রহিম উদ্দীন স্যার। সামগ্রিকভাবে স্যারের কথাটি হয়তো বাস্তবায়ন হবেনা, তবে কিছু কিছু বিষয়ে বাস্তবতা এমনই হওয়া উচিত।
দীর্ঘ বছর থেকে আমরা দেখে আসছি রমযান আসলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বহুগুণে বেড়ে যায়। বাজারে পণ্যের সংকট থাকেনা অথচ দাম বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। মানুষকে কষ্ট দিয়ে যারা ধনকুবের হওয়ার স্বপ্ন দেখে তারা প্রকৃতপক্ষে মানুষ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানুষ কেন মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখাতে পারেনা! বিবেকবোধ থাকার কারণে যে লোকটি মানুষ নামে পরিচয় লাভ করছে। সেই মানুষেরা কীভাবে মুনাফার নামে অন্য মানুষকে কষ্ট দিয়ে নিজে সম্পদের মালিক হয়। কম লাভে কিংবা ন্যায্য দামে পণ্যটি ভোক্তার কাছে পৌছে দেয়া ব্যবসায়ীর নৈতিক দায়িত্ব হলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা যেন তা মনে রাখেন না। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি কোন পণ্যের দাম ১% বৃদ্ধি পায় তবে দেশীয় বাজারে সেই পণ্যের দাম ১০% থেকে ২০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়। যে যার মতো পণের দাম বাড়িয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরী করছেন। এটা কেবল বাংলাদেশই হয়তো সম্ভব। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভাবত বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে রমযান মাস আসলে অধিক পরিমাণে সব কিছুর দাম বাড়ে। বাজার ব্যবস্থা সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকে না বললেই রমজান মাসকে ঘিরে প্রতি বছর পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। যদিও রমজানের আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘রমযানে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। পণ্য সরবরাহ ও মজুদ চাহিদার চেয়ে বেশি রয়েছে।
তাই রমযানে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না।’ কিন্তু তার ঘোষণা কাজে আসেনি। সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে,গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজ, ডাল, ছোলা, চিনি, আদা, রসুনের দাম কেজি প্রতি ৫ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেই সাথে অস্থির ভোজ্যতেলের বাজার। চাহিদার চেয়ে চিনির প্রাচুর্য রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যও বাড়েনি তবুও গত এক মাসে চিনির দাম বেড়েছে প্রায় তিন থেকে পাঁচ শতাংশ। গত ৫ বছরে পারিবারিক আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ আর খরচ বেড়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসেবে, গত দুই বছরে পারিবারিক বিদ্যুতের দাম বেড়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ। বাসা ভাড়া বেড়েছে ২৯ শতাংশ। গত ৩ মাসের ব্যাবধানে গরু ও মহিষের গোস্ত শতকরা ২০ থেকে ২২ ভাগ, ভেড়া ও ছাগল ২৫ থেকে ৩০ ভাগ এবং মুরগীর গোস্তের দাম বেড়েছে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ। জাতীয় সমাজতান্ত্রীক দল গত ১৪ জুন’১৫ প্রস্তাবিত বাজেট ভাবনা ২০১৫-১৬ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত পাঁচ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে ৫০ ভাগ থেকে ২শ’ ভাগ পর্যন্ত। বাজার মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতের কানপুরের অতিবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, নেপালের ভূমিকম্পের কারণে ডালের দাম বাড়ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে একে একে অযুহাত দাড় করিয়ে ব্যবসায়ীরা সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বিগত বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতীতে ব্যবসায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতেই কেউ কেউ মর্জি ফাফিক দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মালামাল মজুদ করে তারাই দাম বৃদ্ধি করছে। জানতে চাইলে আড়তে দাম বেশি বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অপরদিকে আড়ৎদার ও পাইকারি মালিকগণ তাদের এ যুক্তিকে অসত্য বলে মন্তব্য করছেন। সরকার যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছে, সে কারণে প্রথমত সরকারকে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে খতিয়ে দেখা উচিত। পণ্যের দাম কে কে বাড়ায় সেটা নিশ্চিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে সাধারণ মানুষ একটিু স্বস্তিতে জীবন যাপন করতে পারতো। ব্যবসার নামে এভাবে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়া নিঃসন্দেহে জুলুমের অর্ন্তভূক্ত।
ইসলাম ব্যবসাকে হালাল করেছে, অবশ্যই তা নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি মেন পরিচালনা করতে হবে। ব্যবসা হালাল তাই বলে যে যার মতো করে বাজার মূল্য নির্ধারণ করবে এমন স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করা উচিত। সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হতে পারে বা হবে এই সংবাদ শুনেই বাড়ির মালিক বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেন, পরিবহন মালিক যাতায়াত ভাড়া বাড়িয়ে দেন, ব্যবসায়ীরা সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেবেন এমনটি কখনোই কাম্য নয়। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক মানুষ নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। অসৎ ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার আশায় আমদানিকারকদের কৃত্রিম সঙ্কট মানুষকে বিপদে ফেলে দিচ্ছে। এভাবে উর্ধ্বমুখি দামের কারণে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের বেশি কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বর্ষাকালে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আয় রোজগার কম থাকে, তদুপরি শুরু রমযান মাস। খুব শীঘ্রই যদি দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে না পৌছলে মানুষ দুর্ভোগের চরমসীমা অতিক্রম করবে। বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে দেশের কোথাও কোথাও নামমাত্র মনিটরিং ব্যবস্থার কথা শোনা গেলেও মাঠ পর্যায়ে তাদেরকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। বাজার মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দেশের কোথাও কোথাও টিসিবির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের নিয়োগকৃত ডিলার ছাড়াও গোপনে অন্যত্র বিক্রি করছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ ছাপা হয়েছে।
মানুষ তার নৈতিকবোধ হারিয়ে ফেলছে। মনুষত্ব বর্জন করে পশুত্ব চরিত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বৈধ কি অবৈধ কোনটি যেন হিসেব নেই। ন্যায় অন্যায় পার্থক্য করার প্রয়োজন অনুভব করছে না। মানুষের দুঃখ, কষ্ট অনুভব করার অনুভূতি হারিয়ে ফেলছে। সুস্থ বিবেক বলতে কিছু নেই। অসুস্থ আর বিকৃত চিন্তা নিয়ে স্বার্থপরতা বজায় রেখে গোটা বিশ্বকে টাকার জোড়ে জয় করতে মরিয়া হয়ে উঠছে। এ থেকে পরিত্রাণে একমাত্র উপায় আত্মশুদ্ধি। আমরা জানি রমযান নেক অর্জনের মৌসুম। আর মাহে রমজান থেকে আমাদের সে শিক্ষাই নেয়া উচিত। খুব কম লোকই আছেন যারা তাদের গোনাহ মাফের পাশা পাশি অধিক পরিমাণে নেক আমল করতে পারছেন। এ মাসে তাকওয়াই যদি অর্জন না হয় তাহলে সে হতভাগা কিছুই নয়। রমযান উপলক্ষে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে অধিক মুনাফা অর্জনে যারা ব্যস্ত তারা সত্যিকারার্থে মুমিন হতে পাওে না। ব্যবসায়ীদের সম্মান-মর্যাদা বর্ণনায় রাসূল (স.) বলেছেন, ‘সৎ সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী পরকালে নবী, সিদ্দীক ও শহীদদের সাথে থাকবে। (তিরমিযি) সওমের মূল শিক্ষা যতদিনে সমাজে বাস্তবায়িত না হবে ততদিনে রমজান মাসে পণ্যের দাম হয়তো নিয়ন্ত্রণ আসবে না। কিন্তু তার পরেও আমাদের আহ্বান থাকবে, অন্তত রমজানের সম্মানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখুন।