দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১ জুলাই: সারা দেশের বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে বিরোধের কারণগুলো চিহ্নিত করতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাড়ির মালিক ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি এলাকাভেদে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ ভাড়া নির্ধারণের জন্য সরকারকে ছয় মাসের মধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।একটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি বজলুর রহমান ও বিচারপতি রুহুল কুদ্দুসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বুধবার এ রায় দেন।রায়ে বলা হয়, সাত সদস্যের এই কমিশনের প্রধান হবেন একজন আইনজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বে এই কমিশন সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া বিরোধের কারণ নির্ণয় করবেন এবং তা প্রতিকারের উপায় বের করে সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন।
রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, এই কমিশন সুপারিশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারের আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোর সব ওয়ার্ডে হাউস রেন্ট কন্ট্রোলার (বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক) নিয়োগ করতে হবে।২০১০ সালে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ রিট আবেদনটি করে। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় হলোপাঁচ বছর আগের একটি রিট আবেদনের রায়ে বুধবার বিচারপতি মো. বজলুর রহমান ও বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের বেঞ্চ এই নির্দেশনা দেয়।বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করার দাবিতে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এই রিট দায়ের করে।
রায়ে আদালত বলেছে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাত সদস্যের এই কমিশনের প্রধান হবেন আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইনজ্ঞ।এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহায়ণ ও নগর বিশেষজ্ঞ একজন অধ্যাপক, একজন অর্থনীতিবিদ, সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি, ভোক্তা অধিকার ও নাগরিক স্বার্থ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ একজন প্রতিনিধি এবং সরকার মনোনীত একজন সিটি করপোরেশন কর্মকর্তা এই কমিশনে থাকবেন।এই কমিশন ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের মতামত শুনে, প্রয়োজনে গণশুনানির মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করবে। পাশাপাশি দেশের ভাড়াটিয়া ও মালিকদের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে প্রতিকারের সুপারিশ করবে।রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কমিশনের প্রস্তাব অনুসারে সরকার বিদ্যমান বাড়িভাড়া আইন সংশোধনেরও উদ্যোগ নেবে বলে আমরা মনে করি।
সরকার গঠিত কমিশন যেসব সুপারিশ করবে, তা আইনি কাঠামোর রূপ না পাওয়া পর্যন্ত ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রতিটি ওয়ার্ডে বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন করে নিয়ন্ত্রক, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রক ও উপ নিয়ন্ত্রক নিয়োগের উদ্যোগ নিতে বলেছে হাই কোর্ট।রায়ে বলা হয়েছে, সরকার ‘আর্থিক সক্ষমতা সাপেক্ষে’ এই উদ্যোগ নেবে।
এছাড়া কমিশনের সুপারিশ আইনি কাঠামোতে আসার আগ পর্যন্ত কোনো ভাড়াটিয়াকে যাতে উচ্ছেদ বা ভয়ভীতি দেখানো না হয় এবং কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তা যাতে দ্রুত মেটানো হয় এবং প্রয়োজনে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা যাতে নেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করতে সব থানার ওসিদের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।রিটকারী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ রায়ের পর বলেন, রায়ে খুবই খুশি। বাড়িভাড়া নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মানুষ যে অপেক্ষা করছিল সেই পথ খুলে গেল। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিরোধ শতকরা আশি ভাগ কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তিনি বলেন, আদালত এক পর্যবেক্ষণে বলেছে, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ থাকা প্রয়োজন। ওই কর্তৃপক্ষের অধীনে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে।বাড়িভাড়া বাড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায় ভাড়াটিয়া ও বাড়ির মালিকদের মধ্যে অধিকাংশ বিরোধ সৃষ্টি হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।আর আদালতে এই রিট আবেদন হওয়ার আগে ২০০৫ সালে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ২০০৬ সালে ১৪ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং ২০০৭ সালে ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাড়িভাড়া।হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের রিট আবেদনে বলা হয়, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ, বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়াসহ বিভিন্ন বিধান রয়েছে। কিন্তু অনেক বাড়িওয়ালা আইন ভেঙে ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান, যখন-তখন বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেন। তারা ভাড়াটেদের বাড়ি ভাড়ার রশিদ দেন না।ওই আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে ২০১০ সালের ১৭ মে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান কার্যকর করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাই কোর্ট।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ সংশ্লিষ্টদের এর জবাব দিতে বলা হয়।ওই রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি ২০১৩ সালের মে মাসে শেষ হলেও দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই রায় এল।