দৈনিকবার্তা-খাগড়াছড়ি, ১ জুলাই: ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেলের প্রধান এডভোকেট রিপন চাকমা ইউপিডিএফের উপর নিষ্ঠুর রাজনৈতিক দমনপীড়ন চলছে উল্লেখ করে বলেছেন, এ বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ছয় মাসে ইউপিডিএফ ও তার অঙ্গ সংগঠনের ৬ জন খুন এবং ৬৯ জন নেতা-কর্মী ও সমর্থক গ্রেফতার হয়েছেন।
তিনি বলেন, গ্রেফতাকৃতদের মধ্যে অধিকাংশ আদালতের হস্তক্ষেপে জামিনে ছাড়া পেলেও এখনও ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক রিকো চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা রতন স্মৃতি চাকমা ও এলটন চাকমাসহ ১৭ জনকে খাগড়াছড়ি ও ২ জনকে রাঙামাটি জেলে আটক রাখা হয়েছে। মূলত: ‘অবৈধ অস্ত্র রাখা’, ‘চাঁদাবাজি”, ‘ভাঙচুর’ ও ‘সরকারী কাজে বাধা দেয়ার’ মিথ্যা অভিযোগে তাদের আটক করা হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ও উদ্বেগজনক উল্লেখ করে রিপন চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, রয়েছে সর্বক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। ইউপিডিএফ ও তার অঙ্গ সংগঠনকে কোথাও সভা সমাবেশ করতে দেয়া হয়না, যদিও সরকারীভাবে সে রকম কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি খাগড়াছড়ি ও মানিকছড়িতে গত এপ্রিলে সাধারণ জনগণের আয়োজিত বৈসাবি শোভাযাত্রাও পন্ড করে দেয়া হয় এবং গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত খাগড়াছড়ি শহর পরিচ্ছন্ন অভিযানের মতো জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীতেও বাধা দেয়া হয়।তিনি আরো বলেন “জনগণের শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। দীঘিনালায় বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবিতে দীঘিনালা ভূমি রক্ষা কমিটির আয়োজিত শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী হামলা চালিয়ে অনেককে আহত করে। এছাড়া নারীসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন গ্রেফতার আতংক বিরাজ করছে উল্লেখ করে মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেলের প্রধান বলেন, সাজেক, দীঘিনালা, গুইমারা, মাটিরাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক কর্মীসহ সাধারণ লোকজনকে গ্রেফতার, হয়রানি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, গ্রাম ঘেরাও, তল্লাশি এখন নিত্য নৈমিত্ত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রেফতার ও হয়রানির ভয়ে অনেক গ্রাম এখন পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে।রিপন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থতির উন্নতির জন্য ইউপিডিএফের উপর দমনপীড়ন বন্ধ ও সমাবেশের অধিকার প্রদনসহ ৮ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন।
তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী ২০০৯ সালে সৃষ্ট বোরকা পার্টিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ ও আশ্রয় প্রশ্রয় দিচ্ছে ও ইউপিডিএফ সদস্যদের হত্যায় প্ররোচনা দিচ্ছে।সম্প্রতি ২৮ জুন রামগড়ে ইউপিডিএফ সদস্য রঞ্জন চাকমা হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে রিপন চাকমা বলেন, “হামলার কয়েকদিন আগে বোরকা পার্টির (সন্তু লারমা সমর্থিত) ১০-১২ জন সদস্যকে গাড়িতে করে গুইমারা ব্রিগেড ও মাটিরাঙ্গা জোনে এনে রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই তারা তাদের হত্যার মিশন পরিচালনা করেছে।গত ছয় মাসে বোরকা পার্টি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইউপিডিএফের দুই সদস্য উপরোক্ত রঞ্জন চাকমা ও ২৬ জানুয়ারী উচিমং মারমা (১৮) নামে মানিকছড়িতে অপর এক ইউপিডিএফ সদস্যকে গুলি করে খুন করে এবং ২১ জুন বাবুল চাকমা নামে লক্ষ্মীছড়িতে এক ব্যক্তিতে অপহরণ করে।
বোরকা পার্টি ২০০৯ সালে ইউপিডিএফ নেতা রুইখই মারমা হত্যাসহ বহু খুনের সাথে জড়িত। তারা লক্ষ্মীছড়ি সদরে সেনা জোন ও পুলিশ ক্যাম্পের পাশে আস্তানা গেড়ে নিয়মিত সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালনা করে থাকে।
সেটলার হামলাএ বছরের প্রথমার্ধে বড় ধরনের সেটলার হামলার ঘটনা সংঘটিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে এডভোকেট রিপন চাকমা উল্লেখ করেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “১০ জানুয়ারী রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম স্থগিতের দাবিতে অবরোধ চলাকালে অবরোধকারীদের সাথে সেটলার বাঙালিদের সংঘর্ষ হয়। এর জের ধরে সেটলাররা রাঙামাটি শহরে শেভরন ক্লিনিক ও টেলিকম কাস্টমার কেয়ারসহ বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে।
১৮ জানুয়ারী রামগড়ে সোনাই আগা গ্রামে সেটলার আবদুল মান্নান মম মারমা নামে এক ব্যক্তিকে আহত করে। ২২ জানুয়ারী রাঙামাটির বগাছড়িতে সেটলার পাড়ার পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে চান্দি মারমা (২৬) নামে মহালছড়ির সিঙ্গিনালা গ্রামের এক বাসিন্দাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হয় সেটলাররা তার মোটর সাইকেল, মোবাইল ও টাকা পয়সা লুট করার পর তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। ২৫ ফেব্রুয়ারী মাটিরাঙ্গায় একটি যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে সেটলাররা পাহাড়ি যাত্রীদের হেনস্তা ও হয়রানি করে।
১০ এপ্রিল বাঘাইছড়ি উপজেলার খেদারমারা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাবলাখালিতে বৈসাবি উপলক্ষে আয়োজিত ফুটবল খেলার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বেশ কয়েকজন পাহাড়ি আহত হয়। খেলায় বাঙালিদের টিমটি পরাজিত হলে তারা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে পাহাড়িদের উপর হামলা চালায়।পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীদের উপর জাতি বিদ্বেষী যৌন সহিংসতা বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এডভোকেট রিপন চাকমা বলেন, গত ছয় মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে কমপক্ষে ২০ জন পাহাড়ি নারী যৌন হামলার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ধর্ষিত হন ৯ জন ও ধর্ষণ প্রচেষ্টার শিকার হন ১১ জন।”
যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের মধ্যে ১০ ও ১১ বছর বয়সী শিশু ২ জন, ১ জন বাক প্রতিবন্ধী এবং ১ জন গর্ভবতী নারী রয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য দ্বারা ধর্ষণ প্রচেষ্টার শিকার হয়েছেন একজন।রিপন চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৬ মাসে ভূমি বেদখলের হার কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। বান্দরবানের লামায় ভূমি বেদখলের প্রতিবাদ করায় ক্যহলাচিং মারমা (৪৫) নামে এক গ্রাম প্রধানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে জেলে আটক রয়েছেন। এছাড়া গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ৮ মার্চ মহালছড়ির খিয়াংঘাটে সেটলাররা ছায়াবাজি চাকমার (৫০) জমি বেদখল করতে গেলে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।”
তিনি বলেন, পাহাড়িদের হাজার হাজার জমি এখনো বহিরাগত সেটলারদের দখলে রয়েছে। সরকার এ জমি ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ৫ এপ্রিল ২০১৫ জারী করা নির্দেশনা সম্পর্কে রিপন চাকমা বলেন, “এই নির্দেশনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যত বিদেশীদের প্রবেশাধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এই নির্দেশনাকে বর্ণবাদী আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য কিংবা সরকারী কর্মকর্তার উপস্থিতি ছাড়া কোন পাহাড়ি কোন বিদেশীর সাথে কথা বলতে পারবে না বলে নির্দেশ জারী করা হয়েছে, যা সংবিধানে বর্ণিত মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লংঘন।রিপন চাকমা বলেন, “দীঘিনালার বাবুছড়ায় বিজিবির ৫১ ব্যাটালিয়ন কর্তৃক উচ্ছেদ হওয়া ২১ পরিবারকে এখনো মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বিজিবি তাদের বেদখলকৃত জমিতে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের জন্য ইমারত নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, অপরদিকে এর বিরুদ্ধে যাতে কোন ধরনের প্রতিবাদ গড়ে না ওঠে সে জন্য সেনাবাহিনী এলাকায় পাহাড়িদের উপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে।”
জনসংহতি সমিতির সন্তু গ্র“পকে সেনাবাহিনীর বিটিম উল্লেখ করে রিপন চাকমা বলেন, “গত ৬ মাসে সন্তু গ্র“পের হামলায় ইউপিডিএফের ৩ সদস্য ও অপর এক সাধারণ গ্রামবাসী খুন হন। এছাড়া তারা এক বাঙালীসহ ৩ জনকে গুলিতে আহত, দুই নারীসহ ৩ ব্যক্তিকে অপহরণ এবং এক নারীসহ ৬ জনকে মারধর করে।
ইউপিডিএফে মানবাধিকার পরিবীক্ষণ সেলের প্রধান এডভোকেট রিপন চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ৮ দফা সুপারিশ করেন। এগুলো হলো গণতান্ত্রিক দল ইউপিডিএফের উপর রাজনৈতিক দমন পীড়ন বন্ধ করে সভা সমাবেশের অধিকার প্রদান পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেয়া, আটককৃত ইউপিডিএফ নেতা-কর্মী-সমর্থকদের বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া ও তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা তুলে নেয়া, সন্তু গ্রুপের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধের জন্য আঞ্চলিক পরিষদ থেকে সন্তু লারমাকে অপসারণসহ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার ফেরত দেয়া, সেনাবাহিনী ও সেটলারদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে নেয়া,
যৌন হামলার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জারী করা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক ১১টি নির্দেশ বাতিল করা ও খুনীদের সংগঠন বোরকা পার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) এর প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ নিরন চাকমা এক সাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় ।