tib-pc

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৩০ জুন ২০১৫: দেশের ৩১টি জেলার ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৩ হাজার ৬৫৬ জনের উপর জরিপ চালিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)পেয়েছে,এদের ৮৬ শতাংশই মনে করেন এ দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে রাজনীতি৷টিআইবির চালানো এই জরিপের ফল অনুযায়ী,এই যুবদের ৬৬ শতাংশ মনে করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত৷ জরিপে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের এক-তৃতীয়াংশ নারী৷একইসঙ্গে বেসরকারি সেবা খাতের তুলনায় সরকারি সেবা খাতগুলো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলেও মনে করেন তারা৷টিআইবির জাতীয় যুব-সততা জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে৷ মঙ্গলবার ১২টায় ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ জরিপে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি৷প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মনজুর-ই- খোদা এবং শাম্মী লায়লা ইসলাম৷জরিপটি ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৭মে সময়ের মধ্যে পরিচালিত হয়৷ এই জরিপে ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সের ব্যক্তিদের যুব হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে৷ জরিপে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা থেকে ৩১টি জেলার মোট ৩ হাজার ৬৫৬ জন তথ্যদাতার অভিমত নেয়া হয়েছে৷ উত্তরদাতাদের এক-তৃতীয়াংশ হলো নারী৷

টিআইবির তাদের প্রতিবেদনে বলছে, দেশের ৮৬ শতাংশ যুব মনে করেন রাজনীতি হচ্ছে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত৷ আর ৬৬ শতাংশের মতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত৷ জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও সরকারি স্বাস্থ্য সেবা খাতকে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন ৩১ থেকে ৫২ শতাংশ যুব৷ সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা ও চাকরি পেতে এবং আইনী ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা আছে ২৭ থেকে ৩৩ শতাংশের৷জরিপের ফল অনুযায়ী, যুবদের প্রায় সবাই সততার অভাবকে দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের জন্য একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ অধিকাংশ যুবই ধনী হওয়ার চেয়ে সত্‍ হওয়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে৷ অসত্‍ ব্যক্তির চেয়ে সত্‍ ব্যক্তির জীবনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন অধিকাংশ৷ কোনো আত্মীয় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি অথবা কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিতে চাইলে বেশিরভাগ যুবই সরাসরি না বলবেন বলে জরিপে জানানো হয়৷

প্রতিবেদনে আরো বলা আছে, সততা সম্পর্কে যুবদের ধারণার মাত্রা বেশ স্বচ্ছ হলেও বাস্তবে সততা চর্চার ক্ষেত্রে যুবদের একটি বড় অংশের মধ্যে বিপরীত বা নেতিবাচক আচরণ পরিলক্ষিত হয়৷ দেশের বিদ্যমান দুর্নীতিবিরোধী আইন-কানুন, বিধিমালা সম্পর্কে জানেন মাত্র ১ শতাংশ এবং কিছুই জানে না বা এ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই ৫৮ শতাংশের৷ সততা সম্পর্কে জোরালো নৈতিক ধারণা থাকা সত্ত্বেও যুবদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বাস্তব জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সততা বিসর্জন দিতে বা সমঝোতা করতে রাজি আছে; অনেক ক্ষেত্রে তারা দুর্নীতি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সভাপতির বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেখতে চাইলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও যুগোপযোগী করা অত্যন্ত জরুরি৷ সমাজে যুবদের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই তারা যাতে সততার চর্চা করতে পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে তরুণদের ভূমিকা পালনের যথাযথ পরিবশে নিশ্চিত করতে হবে৷টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিকসহ দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রতিটি আন্দোলনে তরুণদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা৷ কিন্তু অধিকাংশ যুবর মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কে ধারণা কম৷ অনেকেই অন্য কোনো উপায় নেই জেনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়৷ সে বিষয়টি মাথায় রেখে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি তরুণদের মধ্যে ও দুর্নীতিবিরোধী চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে৷রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্তদের যুবদের ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে কার্যকর দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে বলে যোগ করেন তিনি৷টিআইবির পক্ষ থেকে ছয় দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়৷ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- দুর্নীতি যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ তা বাস্তবিক অর্থে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা এবং এর মাধ্যমে তরুণদের সামনে এর সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন ও শাস্তি থেকে অব্যাহতির সংস্কৃতি বন্ধ করা৷ আর যুবদের জন্য দুর্নীতির অভিযোগ জানানোর প্রক্রিয়া ও সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত সৃষ্টি করা এবং পাঠ্যক্রমে বিদ্যমান সততা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ক শিক্ষা আরো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা৷

বিচারিক স্বচ্ছতার স্বার্থে এবং নিজেদের জনপ্রিয়তা রক্ষার্থে যেসব মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তাদেরকে স্বেচছায় পদত্যাগ করা উচিত্‍ বলে মন্তব্য করছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান৷টিআইবির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সমপ্রতি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে উঠা দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদিও বিষয়টি বিচারাধীন তবুও যে কথাটি বলা যায়, তা হলো দেশের স্বার্থে এবং নিজের জনপ্রিয়তার স্বার্থে দুর্নীতির অভিযোগ উঠা মন্ত্রীদের পদত্যাগ করা উচিত্‍৷ কেননা এতে করে আইনি লড়াইটা ভালো হয়৷ যদি তারা জয়ী হন পরবর্তীতে জনগণই তাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিয়ে আসবেন৷ তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এসব মন্ত্রীদের পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত্‍৷ এর ফলে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে৷সমপ্রতি অভিযোগ ওঠা গম কেলেঙ্কারি নিয়ে তিনি বলেন, ভেজাল গম আমদানির বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক৷ মন্ত্রী যে প্রত্যাশিত মানের গম আমদানি করতে পারেনি তা স্পষ্ট ও প্রমাণিত৷ আর এটাও প্রমাণিত যে সেখানে ভেজাল গম আমদানি করা হয়েছে৷ সরকারের উচিত্‍ নিজেদের স্বার্থে ও দেশের স্বার্থে গুরুত্ব সহকারে অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান করা এবং অভিযুক্ত মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের মন্ত্রিসভা থেকে বহিষ্কার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা৷

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, তবে আমার মনে হয় রাজনীতির স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, মানুষের রাজনীতির প্রতি যাতে অনিহা তৈরি না হয় এই স্বার্থেও তাদের পদত্যাগ করা উচিত্‍৷ আমাদের দেশে যদিও এ রকম নজির নেই৷ তাই সমপ্রতি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা অন্তত দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্যও পদত্যাগ করতে পারেন৷ এতে তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বাড়বে৷ রাজনীতি কলুষমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে৷

প্রসঙ্গত, দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের সাজা বহাল থাকায় ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে৷ অপরদিকে সমপ্রতি ব্রাজিল থেকে আমদানিকৃত ৪০০ কোটি টাকার পচা গম আমদানির মতো গুরুত্বর অভিযোগের মধ্যে রয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম৷ যদিও তিনি এই আমদানিকৃত পচা গমকে ভালো প্রমাণিত করার জন্য এখনো আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন৷ ত্রাণমন্ত্রী মায়ার দুর্নীতির বিষয়টি বিচারাধীন বলে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁর দুর্নীতির বিষয়টি এখনো বিচারাধীন৷ তাই শুধু এটুকু বলা যায় যে এ ক্ষেত্রে তিনি যদি পদত্যাগ করতেন, তাহলে ভালো হতো৷ এটি একটি নজির হতো৷ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একইভাবে গম নিয়ে খাদ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে৷ এখন পর্যন্ত এটা প্রমাণিত যে গমের মান ততটা ভালো ছিল না৷ তাই খাদ্যমন্ত্রীরও উচিত ছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা৷ তিনি বলেন, এরপর যদি তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে প্রমাণ হতো যে এই ঘটনার সঙ্গে তাঁরা জড়িত নন, তাহলে তাঁরা অনেক বেশি জনপ্রিয় হতেন৷ মানুষ তাঁদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করত৷

টিআইবির যুব সততার জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দুর্নীতি সম্পর্কে যুবকদের স্বচ্ছ ধারণা আছে৷ কিন্তু অনেক সময় পরিস্থিতির কারণে বা বাধ্য হয়ে তাঁদের দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হচ্ছে৷ রাজনীতি ও আইনশখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি যুবকদের ধারণা নেতিবাচক৷ তাঁরা মনে করেন, এসব খাতে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে৷টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের জন্য দুঃখজনক সব কিছু জেনেশুনে তরুণদের দুর্নীতি মেনে নিতে হচ্ছে৷ তারা চাইলেও তাদের মূল্যবোধ কাজে লাগাতে পারছে না৷ তিনি বাজেটে শিক্ষায় কম বরাদ্দ দেওয়ায় সরকারের সমালোচনা করেন৷সংবাদ সম্মেলনে জরিপ উপস্থাপনা করেন টিআইবির গবেষক মঞ্জুর ই খোদা, শাম্মী লায়লা ইসলাম প্রমুখ৷