দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ২৯ জুন: ২০১২ সালে রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার জিরোপয়েন্ট এলাকায় আটতলা ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয়। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) থেকে নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়। কিন্তু ভবন মালিক সাজ্জাদ হোসেন এসএস টাওয়ার নামের সেই ভবনটি পরে ১১ তলায় গিয়ে ঠেকান। এমিনকি আরডিএ’র দেওয়া শর্তানুযায়ী ভবনের সামনে এক দশমিক ৫০ মিটার এবং পেছনে ও উভয় পার্শ্বে এক মিটার করে জায়গা ছেড়ে নির্মাণ কাজ করার কথা থাকলেও সেটিও ভঙ্গ করা হয়েছে।
আরডিএর নিদের্শনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে একেবারে ফুটপাত ঘেঁষে একে একে আট তলার স্থানে ভবন মালিক গড়ে তুলেছেন ঝুঁকিপূর্ণভাবে ১১ তলার অট্টলিকা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নগরীতে শুধু তিনিই নন, তাঁর মতো এভাবে আরডিএকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নগরজুড়ে নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে দেদারছে বহুতল ভবন গড়ে উঠছে একের পর এক। আর আরডিএ কর্তৃপক্ষ দায়সারা গোছের মামলা বা নোটিশ করেই থেমে থাকছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ম বর্হিভূতভাবে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি নকশার অনুমোদন। বিপরীতে ভবন মালিকের নিকট থেকে আদায় করছে লাখ লাখ টাকা। ফলে উৎকোচের পাশাপাশি কখনো কখনো নামেমাত্র জরিমানা দিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে গড়ে তোলা ভবন মালিকরা।
আরডিএ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, নগরীর জিরোপয়েন্টে এসএস টাওয়ার নামের ১১ তলা ভবনটি পাঁচতলা পর্যন্ত নির্মাণ করার পরেই সামনে ১ দশমিক ৫০ মিটার জায়গা না ছাড়ার বিষয়টি নজরে আসে তাঁদের। এরপর আরডিএ ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ভবনের অনুমোদনহীন অংশ কেন অপসারণ করার নির্দেশ দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভবন মালিকের দেওয়া জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আরডিএ’র পক্ষ থেকে ওই বছরের ২৩ জুনের মধ্যে অবৈধ নির্মাণকৃত অংশটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে নির্দেশ পালন না করায় পুনরায় ওই বছরের ৮ জুলাই তিন দিনের মধ্যে অবৈধ নির্মাণ অংশ ভেঙে ফেলার জন্য আরেকটি চিঠি দেয় আরডিএ। তবে এখনো সেই অবৈধ অংশটি ভেঙে ফেলা হয়নি। উপরন্তু আটতলার অনুমোদনের স্থলে পরে আরও তিন তলা বাড়িয়ে মোট ১১ তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছেন ভবন মালিক।
ভবন মালিক সাজ্জাদ হোসেন দাবি করেন, অনুমোদিত নকশার বাইরে বাড়তি তিন তলা নির্মাণ করা হলেও এর বাইরে কোনো আইন ভঙ্গ করেননি তিনি। তাহলে নকশার বাইরে বাড়তি তিন তলা এখন কি হবে জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দেননি। এদিকে রাজশাহী নগরীর অলোকার মোড়ে প্রায় ১৫ বছর আগে নির্মাণ হয় একটি বাড়ি। সামনের অংশে এক তোলা আর পেছনের অংশে দোতলার এই বাড়িটি এখন চারতলায় পরিণত করা হয়েছে। বাড়তি যে অংশটি অতিরিক্ত করা হয়েছে সেটি আরডিএর নকশা বর্হিভূতভাবে। এখানেও আরডিএ কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র একটি চিঠি দিয়ে বসে আছে। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
আরও অভিযোগ উঠেছে, এই ভবনের মালিক রবিউল আলম চারিদিকে নির্ধারিত পরিমান জায়াগা না ছেড়েই ভবনটি নির্মাণ করছেন। এ ব্যাপারে এই ভবন মালিকের প্রতিবেশি হাসান ঈমাম সরকার রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু লাভ হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরডিএ’র তিন নম্বর জোনের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক নকশা বর্হিভূতভাবে ভবনটির বাকি অংশ নির্মাণের কথা স্বীকা করে বলেন, ‘ওই ভবনটি নিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভবন মালিককে নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে।’
আরডিএ সূত্র জানায়, ওই নোটিশ পর্যন্তই থেমে আছে বিষয়টি। কারণ সহকারী প্রকৌশলীসহ আরডিএ কর্তৃপক্ষের উর্ধতন আরো কয়েক কর্মকর্তার পকেটে গেছে মোটা অংকের টাকা। এ কারণেই এ বিষয়টিও এখন থেমে আছে। এদিকে আরডিএর এই নিয়ম লঙ্ঘন করে নগরীর বিন্দুর মোড় এলাকায় হোটেল ডালাস চার তলা থেকে ৮ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০০০ সালে ভবনটি গড়ে তোলার সময় ৪ তলার নকশা অনুমোদন করা হয়। তবে ২০১২ সালে এই ভবন মালিক মোহাম্মদ পলাশকে বাড়তি সামনের অংশে আরও তিন তলা এবং পেছনের অংশে আরও ৬ তলা করে নির্মাণের নকশা অনুমোদন দিয়েছে বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আরডিএর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, হোটেল ডালাস নির্মাণের সময় ৪ তলার ফাউন্ডেশন ছিল। এখন সেখানে সামনের অংশে সাত তলা এবং পেছনের অংশে ১০ তলা করা হলে বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে ভবনটি। অথচ এই ঝুঁকি মাথায় রেখেই আরডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে ভবন নির্মাণের প্রায় ১২ বছর পরে আবার নতুন করে সাত তলা ও ১০ তলা করার জন্য অনুমোদন দেন ওই ভবনটিকে। এ নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টিও হয়েছে। এলাকাবাসীর পক্ষে ভবনটি নির্মাণ নিয়ে ব্যাপকত অনিয়মের অভিযোগে আরডিএ চেয়ারম্যানকে একটি লিখিত অভিযোগও করা হয়েছে।
ডালাসের মালিক মোহাম্মদ পলাশও পরবর্তিতে অতরিক্তি অংশের নকশা অনুমোদনের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘পুনরায় নকশা অনুমোদনের পর আবার বাড়তি অংশের কাজ শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে গোটা হোটেলটির চার তোলার ওপরে আরও ৩ তিন তলার অনেকটা কাজ এগিয়ে গেছে।’
অন্যদিকে একাধিক বাড়ি মালিক অভিযোগ করেছেন, নগরীর লক্ষীপুর, সাহেব বাজার, ঝাউতলার মোড়সহ আরো বিভিন্ন এলাকায় একই কায়দা নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে গড়ে উঠছে বা উঠেছে বহুতল ভবন। এমনকি খোদ আডিএ কর্তৃপক্ষও তাদের নিয়ম লঙঘন করে বহুতল মার্কেট গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছে আরডিএ মার্কেট, নগরীর শিরোইল বাসস্ট্যান্ড মার্কেটের ক্ষেত্রে। এসব নিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক মিডিয়াগুলোতে এর আগেও একাধিক প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি।
অপরদিকে নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে রাজশাহীতে শতশত ভবন গড়ে উঠেছে বলেও একাধিক সূত্র দাবি করেছে। এর মধ্যে একশটির মতো ভবন মালিকের বিরুদ্ধে এখন বিচারাধিন মামলা রয়েছে বলে দাবি করেছেন আরডিএর অ্যাস্ট্যাট কর্মকর্তা বদরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘নকশা বর্হিভূতভাবে বাড়ি নির্মাণ করার কারণে আমরা অনেক বাড়ি মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। এখনো প্রায় ১০০টি মামলা বিচারাধিন আছে।’ খোদ বাড়ি মালিকরাই অভিযোগ করে জানান, এই প্রক্রিয়া শতশত বাড়ি মালিকের নিকট থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আরডিএ কর্তপক্ষ। এর ফলে সরকার যেমন বিপুল অংকের টাকা জরিমানা পাওয়া থেকে বিরত থাকছে, তেমনি রাজশাহী নগরীতে গড়ে উঠছে নকশা বিচ্যুতি ঘটিয়ে শতশত দালান কোঠা গড়ে উঠছে। এসব প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, আরডিএ’র অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘নির্দেশ অমান্য করার কারণে বেশকিছু ভবন মালিকটির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এখনো সেগুলো বিচারাধিন রয়েছে।’ তবে ভবন মালিকের নিকট থেকে উৎকোচ আদায় হচ্ছে কিনা সে বলতে পারবো না ‘