দৈনিকবার্তা-লালমনিরহাট, ২৮ জুন: লালমনিরহাটের তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ার সাথে সাথে ভাঙ্গনের মাত্রা বেড়ে গেছে কয়েক গুন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এলাকা নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। গত ১৫ দিনে জেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২ শতাধিক পরিবার নদী গর্ভে চলে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার অন্তত ২০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাঙ্গনের শিকার তিস্তা পাড়ের মানুষ জনের জীবন যাত্রা দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গত শনিবার তিস্তা তীরবর্তী এলাকা ঘুরে ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে বের হয়ে আসে ভাঙ্গনের এ করুন চিত্র।জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সফিয়ার রহমান জানান, তার ইউনিয়নে গত ১৫ দিনে অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। তিস্তার ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে পশ্চিম হলদিবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, পূর্ব হলদিবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পশ্চিম হলদিবাড়ি এবতেদায়ী মাদরাসা।
ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়ন চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বাবলা জানান, গত ১৫ দিনের ভাঙ্গনে তার ইউনিয়নের শতাধিক বসত বাড়ি নদী গর্ভে চলে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে দক্ষিণ ডাউয়াবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তর ডাউয়াবাড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যায়, আছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, দক্ষিণ ডাউয়াবাড়ি এবতেদায়ী মাদরাসা।সিন্দুর্না ইউনিয়ন চেয়ারম্যান খতিব উদ্দিন, সিঙ্গিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এম জি মোস্তফা ও গড্ডিমারী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জালাল উদ্দিন বুলু জানান, তাদের স্ব স্ব ইউনিয়নেও তিস্তা নদী ভাঙ্গন বেড়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন বসতবাড়িসহ অসংখ্য আবাদী জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে।
এ ছাড়া কালীগঞ্চ উপজেলার ভোটমারী ও জমির বাড়ী,আদিতমারী উপজেলার মহিষ গোছা ও লালমনিরহাট সদরের কুলাঘাট ,মোঘল হাট ইউনিয়নের শতাধিক বসত বাড়ি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। হাতিবান্ধা উপজেলার পুর্ব সিন্দুনা গ্রামের মমতাজ আলী জানান, ৭ দিন আগে তার বাড়িতে ৫ টি ঘর ছিল, কিন্তু এখন তার কোনো অস্তিত্ব নেই। একই অবস্থার মুখোমুখি হোসেন আলী জানান, ৩ বছর আগে সেখানে তাদের বাড়ি ছিল তা নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় ১ কিঃ মিঃ দুরে শেষ জমি টুকুতে তারা বাড়ি করে আশ্রয় নেয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার সকালে তাও নদী গর্ভে চলে য়ায়। ঘরহারা মানুষ জনের বুকফাটা কান্নায় অসহনীয় পরিবেশে রুপ নিয়েছে তিস্তা পাড়।
এদিকে ভাঙ্গন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভাঙ্গন প্রসঙ্গে হাতিবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বাবলা জানান, নদী ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কোনো ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে তিস্তা তীববর্তী লালমনিরহাট জেলার অধিকাংশ এলাকা নদী গর্ভে চলে যাবে, হারিয়ে যাবে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান।বন্যা ও নদীর ভাঙ্গনে তিস্তা পাড়ের মানুষ জনের দুর্দশা এখন চরমে। গৃহ হারা হয়ে পড়েছে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। স্কুল, মাদ্রাসা ও মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানের আশ্রয় নেয়া মানুষ গুলো অনাহারে – অর্ধাহার আর বিভিন্ন রোগের প্রার্দুভাবে ক্লান্ত ও বিধবস্ত। নদীপাড়ের লোকজন অমানবিক জীবন যাপন করছে। খাবার সংকটের পাশাপাশি সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। পানি বন্দি লোকজনের মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতংক। এ চিত্র গত ২০ দিনের।
নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা গুলো ঘুরে লোক জনের সাথে কথা হলে বের হয়ে আসে বন্যা, তিস্তার পানি বৃদ্ধি ও নদীর ভাঙ্গন নিয়ে নতুন তথ্য। লোক জনের দাবী ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দিলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পায়। এতে হাতিবান্ধায় অবস্থিত সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজ হুমকির সম্মখীন হলে পাউবো কৃর্তপক্ষ ব্যারেজের সব গেট খুলে দেয়। এতে গোটা লালমনিরহাট জেলায় বন্যা দেখা দেয়। তিস্তা পাড়ের লোক জন জানান, গজল ডোবা ব্যারেজ থেকে তিস্তা ব্যারেজে পানি আসতে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগে। ভারত সব সময় গজল ডোবা ব্যারেজের গেট এক নিয়মে খুলে রাখলে তেমন বন্যা ও নদী ভাঙ্গন দেখা দিত না। তাদের দাবী সারা দিন ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের গেট বন্ধ রেখে পানি বৃদ্ধি করে বিকালে আগে গেট খুলে দেয়।
সন্ধ্যার পর পর এ পানি প্রচন্ড গতিতে তিস্তা ব্যারেজে আঘাত হানে। ফলে পাউবো ওই ব্যারেজের সব গেট খুলে দিয়ে ব্যারেজ রক্ষার চেষ্ট্রা করে। আর এ পানিতে গোটা লালমনিরহাট জেলায় বন্যা দেখা দেয়। মধ্য রাত পযর্ন্ত পানি বাড়তে থাকে। আবার ভোরের দিকে গজল ডোবা ব্যারেজের গেট বন্ধ করে দিলে সকাল হতে হতে পানি কমে যায়। এ – চিত্র প্রতিদিনের। হাতিবান্ধা উপজেলার সির্ন্দুনা গ্রামের রহমত, বক্কর, বাবুসহ অনেকেই জানান, তিস্তার পানি দিনে কমে আর রাতে বাড়ে। পানি বাড়ার সাথে সাথে মানুষ জনের দুঃখ – দুর্দশা বাড়তে থাকে। এটা বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বৈরী আচরণ। আর ভারতের এ আচরণের কারণে লালমনিরহাট জেলার লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দি গত ১৫ দিন ধরে।
নদী ভাঙ্গন ও বন্যার কারণে ইতোমধ্যে চর এলাকা গুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে। খবর আসছে পানি বন্দি পরিবার গুলো মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। পানি বন্দি ও নদী ভাঙ্গনের শিকার পরিবার গুলোর অভিযোগ , এখন পর্যন্ত তাদের মাঝে কোন ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। তারা অনাহারে – অর্ধাহার আর বিভিন্ন রোগের প্রার্দুভাবে ক্লান্ত ও বিধবস্ত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। পাশা পাশি বিভিন্ন পানি বাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। গত ১৫ দিনে গোটা লালমনিরহাট জেলায় বন্যার কারণে শতাধিক মানুষ পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লালমনিরহাট জেলা প্রসাশক হাবিবুর রহমান জানান, এ জেলায় ৫ টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশী নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে হাতীবান্ধা উপজেলা। আমরা ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে খোজঁখবর নিচ্ছি। এবং তাদের পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।