দৈনিকবার্তা-ময়মনসিংহ, ২৪ জুন: এক সময় সারা দেশেই প্রচুর কুচিয়া মাছ দেখা যেত। আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত কুচিয়া খেত না। তবে বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অবাধে আহরণ করে রপ্তানীও করা হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশে। এছাড়া জলাশয় ভরাট, প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশের অভাবসহ নানা কারণে কুচিয়া মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এই মাছ এখন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায়। সম্প্রতি হারিয়ে যাওয়া কুচিয়া মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে কুচিয়া মাছ চাষ এবং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।বিপন্ন প্রজাতির দেশীয় কুচিয়া মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান বিজ্ঞানী ড. হারুনুর রশীদ।
অতীতে দেশীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কুচিয়ার প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফল হলেও পোনার খাবার ব্যবস্থাপনা করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনে কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়নি। তবে ড. হারুন কুচিয়ার প্রজনন, পোনা উৎপাদন এবং পোনার খাবার ব্যবস্থাপনা করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি উদ্ভাবনে এক ধাপ সফলতা পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
ড. হারুনুর রশীদ জানান, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাল-বিল থেকে আহরিত কুচিয়া সাধারণত দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় রপ্তানি হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৭ লাখ ডলারের কুচিয়া রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরে তা এক কোটি ডলার ছাড়িয়ে ছিল। তিনি বলেন, দেখতে সাপের মত হলেও কুচিয়া আসলে বাইম ও গুচি জাতীয় একটি মাছ। মাছটি খুবই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু এবং ঔষধি গুণসম্পন্ন। বর্তমানে কুচিয়াকে ঘিরে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় অন্য মাছের মত বদ্ধ জলাশয়ে এর চাষে আগ্রহ বাড়ছে।
আমাদের দেশের উপজাতীয়দের কাছে কুচিয়া মাছ খুবই জনপ্রিয় খাবার। সারা পৃথিবীতে দুই ধরনের (গড়হড়ঢ়ঃবৎঁং পঁপযরধ এবং গড়হড়ঢ়ঃবৎঁং ধষাঁং) কুচিয়া পাওয়া যায়। দেশীয় একটি কুচিয়ার ওজন সাধারণত ৩০০ থেকে ২০০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। পুথিবীর অন্য দেশে কুচিয়ার ওজন ১০০০ গ্রামের বেশি হয় না। ফলে বিদেশে বাংলাদেশি কুচিয়ার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কুচিয়ার ব্যাপক চাহিদা থাকায় এ দেশের ময়মনসিংহ, শেরপুরের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতি থেকে প্রজননক্ষম মা কুচিয়া সংগ্রহ করে রপ্তানি করা হচ্ছে। ফলে দিন দিন প্রকৃতিতে কমে যাচ্ছে কুচিয়া মাছ। ২০০০ সালের দিকে কুচিয়াকে বাংলাদেশের বিপন্ন মাছের প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ড. হারুন আরো বলেন, ‘কুচিয়ার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের জন্য কৃত্রিম পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের বিকল্প নেই। এসব বিষয়কে সামনে রেখে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) অর্থায়নে আমরা গবেষণা শুরু করি। গবেষণার প্রথম দিকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে কুচিয়া সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজননের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রজনন হরমোন প্রয়োগ করি। কিন্তু অন্য সব মাছের মতো কুচিয়ায় প্রজনন হরমোন দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন করানো সম্ভব হয়নি। পরে আমরা গবেষণা পুকুরে কুচিয়ার প্রজননের জন্য উপযোগী কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করে পোনা উৎপাদনে সফল হই।
গবেষক ড. হারুন বলেন, কুচিয়ার পোনা উৎপাদনের থেকেও কঠিন কাজ হলো পোনাকে বাঁচিয়ে রাখা। অর্থাৎ পোনা উৎপাদনের তিন দিন পর থেকে সাধারণত পোনাকে খাবার সরবরাহ করতে হয়। কিন্তু কুচিয়ার পোনা আমাদের প্রচলিত খাবার গ্রহণ না করায় পোনাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে কুচিয়ার বাণিজ্যিক পোনা উৎপাদনের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পোনার খাবার। তবে আমরা উৎপাদিত পোনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাবার নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি। ওইসব খাবার ব্যবহার করে আমরা পোনাকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি।
ওইসব খাবারের মধ্যে কোনটিতে সব থেকে ভালো ফল পাওয়া যায় সে বিষয়ে এখন গবেষণা চলছে। আশা করছি, আমরা খাবার বিষয়টি নির্ধারণ করতে পারলে কুচিয়ার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।কুচিয়া মাছকে প্রচলিত প্রজনন হরমোন দিয়ে উদ্দীপ্ত করে কৃত্রিম প্রজনন করা সম্ভব নয়। ভিয়েতনাম তাদের কুচিয়া প্রজাতিকে কৃত্রিম প্রজনন করানোর জন্য গবেষণা কওে প্রজনন হরমোন উদ্ভাবন করেছে। ফলে তারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপক হারে পোনা উৎপাদন করতে পারছে। আমাদের দেশীয় কুচিয়ার জন্য সে রকম একটি প্রজনন হরমোন উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কিত গবেষণা ব্যাপক ব্যয়বহুল, তাই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।