দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ জুন: শনিবার (২০ জুন ২০১৫) বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এ দেশের সমাজপ্রগতি আন্দোলনের অগ্রপথিক মানবতার মৃন্ময়ী জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামালের ১০৪তম জন্মবার্ষিকী। এই উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতি বছর ২০ জুন কবি সুফিয়া কামাল স্মারক বক্তৃতা ও সুফিয়া কামাল সম্মাননা পদক প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। শনিবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে সুফিয়া কামাল স্মারক বক্তৃতা প্রদান, আট জন বিশিষ্ট নারীকে সুফিয়া কামাল সম্মাননা পদক প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আয়শা খানম। ‘সুুফিয়া কামালের সাহিত্য: মানবতাবাদ ও নারীর অধিকার’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। সঙ্গীত পরিবেশন করেন ইফ্্ফাত আরা দেওয়ান ও বুলবুল ইসলাম।
এ বছর সুফিয়া কামাল সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়- ভাষা সৈনিক হালিমা খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা বাচ্চু ও প্রতিভা মুৎসুদ্দি; বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি মিলি বিশ্বাস; বেলাবোর কৃষক নারী ফরিদা বেগম; সাভারের শ্রমিক নারী আরতী রানী; কাউখালীর স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধি মমতা শিকদার- এই আট জনকে।অনুষ্ঠানের সভাপতি আয়শা খানম কবি সুফিয়া কামালকে বাংলাদেশের বিবেক বলে অভিহিত করে বলেন যে, আত্মজাগরণ ও আত্মঅনুসন্ধানের মাধ্যমে তিনি তাঁর সাহিত্যে যা বলেছেন নিজের জীবন চর্চায় তা বাস্তবায়ন করার পথ দেখিয়ে গেছেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে তিনি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও মানবের সম্মিলিত জীবনে পরিণত করেছেন। নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং যে সব পেশা, যেমন শান্তি মিশনে, সাংবাদিকতায়, ক্রীড়াঙ্গনে এখন নারীরা পুরুষের সাথে সমান তালে এগিয়ে এসেছে- এই অগ্রগতির আলোকিত পরিসরে সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের বাতিঘরের মত। তিনি বলেন, সুফিয়া কামালের রচনার মধ্যে যে আলোকদায়ী বক্তব্য তা নিয়ে ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়নি, বাংলা একাডেমির মাধ্যমেও তেমন হয়নি। একইভাবে সমাজপ্রগতির আন্দোলনে নারীসমাজের নিভৃত ও ধারাবাহিক ভূমিকাকে দৃশ্যমান করে তোলার লক্ষ্যে তেমন গবেষণা হয়নি। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করার জন্যে ইতিহাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। যুগে যুগে নারীর অবদানকে যথাযথভাবে মূল্যায়নের জন্যে প্রয়োজনীয় গবেষণার জন্যে দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
স্বাগত বক্তব্যে মালেকা বানু বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ একটি মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রামের প্রধান লক্ষ্য। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, অব্যাহত নারী নির্যাতন, নারীর শ্রমশোষণ ও পাচারের মাধ্যমে নারীকে যেভাবে পণ্যে পরিণত করা হচ্ছে, এ সময়ে সুফিয়া কামালের রচনাবলী, জীবনবীক্ষা ও আদর্শ আমাদের আলোর দিশা দেখাতে পারে।স্মারক বক্তৃতায় অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল উল্লেখ করেন, সাহিত্যের কৃতি ও চর্চার মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল বৈচিত্র্যসন্ধানী হয়েছেন যেমন, তেমনি নারী ও মানবাধিকার নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সাহসীবাণী উচ্চারণ করেছেন। নারীই মুক্ত করবে বন্দি মানবতাকে-রবীন্দ্রনাথের ‘নারী’ প্রবন্ধের অনুরূপে সুফিয়া কামালের এ আশাবাদ। নবযুগের চেতনায় নারীর অধিকার আর মানবাধিকার একই মুদ্রার দুইপিঠ। এটি সুফিয়া কামাল বুঝেছিলেন, তাই সংগ্রাম তাঁর কাছে বিলাস ছিল না। জীবনের উর্বরতা, সাম্যময়তা, আলোময়তার জন্যেই এই অমৃত মমতা প্রয়োজন। কবিতা রচনা ছিল তাঁর শুধুই আত্মিক পরিচর্যার ব্যাপার নয়, তাঁর নান্দনিক প্রয়াস ছিল বাঁধন ছেড়ার, মুক্ত একটি পরিসর রচনার; তাঁর এই কথা আমাদের স্মরণে জাগে যে, ‘এগিয়ে চলতে পারলে সামনের বাধা পেছনে সরে যায়।’ তাঁর সাহিত্য আমাদের মনকে, চিত্তকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কালের বুকে এটাই সুফিয়া কামালের অনন্য কৃতিত্ব।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম। সম্মাননা প্রদকপ্রাপ্ত আটজন বিশিষ্ট নারীর জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাখী দাশ পুরকায়স্থ, সহ-সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা, প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা, প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক দিল মনোয়ারা মনু, প্রশিক্ষণ গবেষণা ও পাঠাগার সম্পাদক রীনা আহমেদ, আন্দোলন সম্পাদক কাজী সুফিয়া আখতার ও পরিবেশ সম্পাদক পারভীন ইসলাম। অনুষ্ঠানে মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা মহানগর শাখার সদস্যবৃন্দ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ তিনশতাধিক উপস্থিতি ছিলেন।