দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ জুন: প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, অতীতের মতো বিশাল অংকের এই প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন করে দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।তিনি প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনাকে মতলবি উল্লেখ করে বলেন, বড় বাজেটের কথা যারা বলেন তারা মতলবি কথা বলেন। এই বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়েনি।রোববার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশনের শুরুতে প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা-উত্তর টেবিলে উপস্থানের পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়।গত ৪ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৯৫ হাজার ১শ’ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন।২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট আলোচনার ৮ম দিনে কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতি মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, সরকারি দলের সদস্য মোহাম্মদ ফারুক খান, টিপু সুলতান, মাহবুব আলী, আবু সাঈদ আল-মাহমুদ স্বপন, বেগম ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, এ কে এম ফজলুল হক, মোঃ হাবিবে মিল্লাত, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম মিলন ও মামুনুর রশীদ অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বড় বাজেট উপ¯’াপনের জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আগেও সরকার এ ধরনের বড় বাজেট আন্তরিকতার সাথে বাস্তবায়ন করেছে।তিনি বলেন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট যখন উপস্থাপিত হয়েছে তখন সরকারের সাফল্য সর্বক্ষেত্রে প্রশংসিত হয়েছে। দেশের বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, খাদ্য-শস্য উৎপাদন, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে আসা, অতি দারিদ্র্য ৩ ভাগের ২-এ নেমে আসাসহ অর্থনীতির এমন কোন বিষয় নেই, যেখানে উন্নয়ন হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকার ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরটি ছিল অস্থিতিশীলতার বছর। ওই সময়ে ৩ মাস লাগাতার অবরোধের নামে পেট্রোল বোমা দিয়ে নিরীহ জনগণকে অগ্নিদগ্ধ করা হয়েছে। মায়ের পেটের শিশুসহ তাদের নৈরাজ্যের হাত থেকে রেহাই পায়নি। পেট্রোল বোমা দিয়ে তারা শবে বরাতের রাতেও মানুষ হত্যা করেছে। আর এসব নাশকতা করে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না করলে প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। তারপরও বিএনপি-জামায়াত জঙ্গিচক্রের নৈরাজ্যকর ধ্বংসাত্মক ও নজিরবিহীন নাশকতার কর্মকান্ডের পরও দেশের অর্থনীতির সকল সূচক উর্ধ্বগতিতে রয়েছে।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি ও সাহসী বাজেট দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এটাই প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের অব্যাহত ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের মাঝেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা এগিয়ে গেছে। এবার ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় বেশি।তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির ধারা ৬ শতাংশ অব্যাহতভাবে বজায় রাখা সারা বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও প্রবৃদ্ধির এ ধারায় সরকারের প্রশংসা করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে বাংলাদেশ-ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উপনীত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে স্থল সীমান্ত চুক্তি। এর ফলে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান করেছেন। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানচিত্র একটি পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে, যা দুই দেশের সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়ে থাকবে। যেসব সমঝোতা ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এতে বাংলাদেশই লাভবান হবে। এতেই বুঝা যায় শেখ হাসিনার কূটনীতি দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্যে।ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে না বিএনপি’র এ ধরনের নেতিবাচক সমালোচনা প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী বলেন, তারা জানেনই না যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য গেলে কোন প্রকার কর দিতে হয় না।
তিনি সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার ইতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন, ব্যাংকিং খাতের তারল্যের অভাব নেই। নিয়মিত ও সঠিক ব্যবসায়ীদের ঋণ নিতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবে না, এ কথা সঠিক নয়।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, এসএসসি পরীক্ষার সময় বিএনপি-জামায়াত হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনের ব্যাপক ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করলেও পরীক্ষায় তারা ভালো ফলাফল করেছে। এ জন্য তিনি এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে। আর্থ-সামাজিক সব সূচকই বর্তমানে উর্ধ্বমুখী। দেশের মানুষকে জনশক্তিতে পরিণত করা হচ্ছে। বিশেষ করে জনসংখ্যার অর্ধেক নারীদের জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতে আনার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।তিনি বলেন, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকার অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নর নয়, সামাজিক অর্থনৈতিকসহ সব খাতেই নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার কার্যক্রম চলছে ।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের নারী ও জেন্ডার বান্ধব নীতি এবং কার্যক্রমের ফলে দেশে বর্তমানে শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা এসেছে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছ্ েএ জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ পুরস্কার পেয়েছেন।
সরকারি দলের মোহাম্মদ ফারুক খান বলেন, অতীতের মতো প্রস্তাবিত এ বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। বর্তমান সরকারের অতীতের ৬টি বাজেট শতকারা ৯৫ ভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। প্রায় শতভাগ বাস্তবায়নের ফলে দেশে দারিদ্রের হার ৪৮ দশমিক ৬ ভাগ থেকে কমে ২৪ ভাগে নেমে এসেছে। শুধু তা নয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা,সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সব খাতের উন্নয়ন আজ বিশ্বের কাছে রোল মডেল।তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য, দক্ষ, ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বের ফলে এসব সাফল্য অর্জিত হয়েছে।সরকারি দলের অন্য সদস্যরা বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই বাজেটে এ ব্যাপারে কোন দিক নির্দেশনা নেই। দেশে এখন মুদ্রাস্ফীতি কম, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন বাড়ছে, মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে এবং আমদানী রফতানী পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কূটনৈতিক দূরদর্শীতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের সমস্যা সমাধান হয়েছে। বাজেটে এই ছিটমহলের উন্নয়নে ২শ’ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা আরো বাড়ানোর জন্য তারা দাবি জানান।
তারা প্রস্তাবিত বাজেটকে কৃষি, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ বান্ধব উল্লেখ করে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের মাধ্যমে দেশ ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে দারিদ্র বিমোচনকে প্রধান টার্গেট করতে হবে। বিশেষ করে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠিকে দারিদ্র সীমার নিচ থেকে উপরে তুলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই এ বাজেটের সুফল জাতি ভোগ করতে পারবে।
তারা বাজেটে শিক্ষা, চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি করেন। তারা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এ দুই গুরুত্বপূর্ণ খাতে চলতি অর্থ বছরের তুলনায় বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। অথচ মানব সম্পদ উন্নয়ন করতে হলে এ দুই খাতকেই প্রাধান্য দেয়া দরকার। তারা এমপিও ভুক্ত হয়নি এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার দাবি জানান।
তারা বলেন, বর্তমান সরকার আমলে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জাতীয় উন্নয়নের চাকা সামনের দিকে ধাবিত করা সম্ভব হয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক সকল সূচক উর্ধ্বমুখী রয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য উৎপাদন, বিদ্যুৎ- জ্বালানি, যোগাযোগ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, দারিদ্র বিমোচন, সামাজিক সুরক্ষা, সুশাসন, সামাজিক ন্যায় বিচারসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য ও দূর-দৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের ফলে দেশ যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে নতাতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশ অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। তারা আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার বাজেট উল্লেখ করে বলেন, এ বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত গড়ার পথে দেশকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সরকারি দলের সদস্যরা বলেন, বর্তমান সরকার দেশে আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গত ৭ বছরে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে অসহায় গরীব মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা বজেটে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বৃদ্ধির জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তবে তারা সকল মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ১০ হাজার টাকা নির্ধারণের আহবান জানান।