দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৯ জুন: একাদশ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের কাছে বির্তকিত হারে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়েছিলো বাংলাদেশ। মেলবোর্নে সেই হারের প্রতিশোধ মিরপুরে নিলো টাইগাররা। অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা তরুণ পেসার মুস্তাফিজুর রহমানের পাঁচ উইকেট শিকারে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতে ভারতকে ৭৯ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ফলে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল মাশরাফি বাহিনী।মিরপুরে টস জিতে প্রথম ব্যাট করে ৩০৭ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। জবাবে ৪ ওভার বাকি থাকতেই ২২৮ রানে গুটিয়ে ম্যাচ হারে টিম ইন্ডিয়া। এই নিয়ে চতুর্থবারের মত ভারতকে ওয়ানডে ক্রিকেটে হারালো বাংলাদেশ।প্রথম ওয়ানডে জয়ের জন্য ৩০৮ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে উড়ন্ত সূচনাই করেন ভারতের দুই ওপেনার রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ান। ১৬ ওভার পর্যন্ত উইকেটে টিকে থেকে স্কোর বোর্ডে ৯৫ রান তুলে ফেলেন তারা। এই জুটি আরও ভয়ংকর হবার আগে তাতে ভাঙ্গন ধরিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেন পেসার তাসকিন। ৩০ রান করা ধাওয়ানকে ফিরিয়েছেন তিনি।
এরপর ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের যাওয়া আসার মধ্যে রাখেন বাংলাদেশের বোলাররা। ১০১ থেকে ১২৮ রানের মধ্যে ভারতের আরও চার ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে ম্যাচের লাগামটা নিজেদের হাতের মুঠোয় আনে টাইগাররা। এরমধ্যে তাসকিন কোহলিকে ১ রানে, রোহিতকে ৬০ ও রাহানেকে ৯ রানে ফেরান অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা মুস্তাফিজুর।তাসকিন ও মুস্তাফিজুরের সাথে সাথে যুুদ্ধের ময়দানে যোগ দেন সাকিব। তাতে বাংলাদেশের জয়ের পথের বড় কাটাঁ টিম ইন্ডিয়ার দলপতি মহেন্দ্র সিং ধোনি ৫ রানে শিকার হন সাকিবের।বাংলাদেশ যখন সহজ জয়ের চিন্তায় বিভোর, তখন তাতে একটু বিঘœ ঘটানোর চেষ্টা করেন সুরেশ রায়না ও রবীন্দ্র জাদেজা। সেই বিঘœতা ছিলো ৬৭ বল। এতে রান উঠে ৬০। ফলে ম্যাচ ঘোড়ানো স্বপ্ন ভারতের চোখে। সেই স্বপ্ন ধুলিসাৎ করেন আরও বড় স্বপ্ন নিয়ে প্রথম ওয়ানডে খেলতে নামা মুস্তাফিজুর।ভড়কে দেয়ার মত এক ডেলিভারিতে ব্যক্তিগত ৪০ রানে রায়নাকে থামিয়ে দেন মুস্তাফিজুর। রায়না যেহেতু ভড়কে গেছেন, স্বাভাবিকভাবে সেই ফাঁেদ কুপোকাত হবেন ভারতের অন্যান্য ব্যাটসম্যানরাও। ঠিক হয়েছেও তাই।
রায়নার বিদায়ের পর উইকেটে আসা রবীচন্দ্রন অশ্বিনকে প্রথম বলেই ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজুর। এরপর ঐ একই ধরনের ডেলিভারিতে জাদেজাকে ৩২ রানে আউট করে অভিষেক ম্যাচেই পাঁচ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব দেখান মুস্তাফিজুর। অভিষেকেই পাঁচ উইকেট নেয়া দ্বিতীয় বাংলাদেশী বোলার মুস্তাফিজুর।এরপর ভারতকে হারের স্বাদ দিতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি বাংলাদেশকে। ইনিংসের ৪ ওভার বাকী থাকতেই ২২৮ রানে ভারতকে অলআউট করে দেয় স্বাগতিকরা। বাংলাদেশের পক্ষে মুস্তাফিজুর ৫টি, তাসকিন ও সাকিব ২টি করে উইকেট শিকার করেন। ম্যাচের সেরা হয়েছেন মুস্তাফিজুর। আগামী ২১ জুন একই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডে।এর আগে, মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে দুপুরের কড়া রৌদ্রের আলোতে টস-এর কয়েন তাকিয়েছে বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ডাকে। তাতেই মাশরাফির মুখে চওড়া হাসি। কিছুটা হলেও অবাক করেছেন ম্যাশ। ‘বৃষ্টি’ সমীকরন মাথায় থাকার পরও প্রথম ব্যাট করার সিদ্বান্ত মাশরাফির। কিন্তু দলপতির সিদ্বান্ত যতটা না অবাক করার বিষয় ছিলো, তার চেয়ে বেশি অবাক করেছেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকার। উইকেটে গিয়েই রান তোলায় অস্থির হয়ে উঠেন তারা। ফলে ১০ ওভারেই দলের স্কোর গিয়ে দাড়াঁয় বিনা উইকেটে ৭৯ রানে। এসময় নিজেদের মধ্যেই প্রতিন্দ্বন্দিতা করেছেন তামিম ও সৌম্য। তাতে এগিয়েই ছিলেন সৌম্য। ২৯ বলে ৩৯ রান ছিলো সৌম্যর নামের পাশে। আর তামিমের পাশে শোভা পাচ্ছিল ৩২ বলে ৩৭ রান। দু’জনে মিলে বাউন্ডারির হাকিয়েছেন ১১টি, আর মাটির স্পর্শ ছাড়াই বল বাউন্ডারি ছুয়েঁছে একবার। এরমধ্যে তামিমের ছিলো ৪টি চার ও ১টি ছক্কা।
দুই ওপেনারের এমন বিধ্বংসী ব্যাটিং-এ উদ্বোধনী জুটি আরও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। সেই স্বপ্ন আরও বড় হয় যখন ১৪তম ওভারের প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাকিয়ে দলের স্কোর ১’শ রানে নিয়ে যান সৌম্য। আর ঐ বাউন্ডারিতে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদটাও নিয়ে নেন সৌম্য। তবে ঐ ওভারের চতুর্থ বলেই সৌম্যর নান্দনিক ইনিংসটার ইতি ঘটে, তামিমের সাথে রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে ভুল বুঝাবুঝিতে। তাতে কষ্টটা বেশিই পেয়েছেন তামিম, সেই সাথে মাঠে উপস্থিত প্রায় ১৫’হাজার দর্শক। ৮টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪০ বলে ৫৪ রানে আউট হবার আগে অবশ্য তামিমের সাথে ১০২ রান করে উদ্বোধনী জুটিতে রেকর্ড গড়েছেন সৌম্য। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ ওপেনারদের এটিই সর্বোচ্চ উদ্বোধনী জুটি। আগেরটি করেছিলেন ইমরুল কায়েস ও তামিম ইকবাল। ২০১০ সালে এই মাঠেই ৮০ রানের জুটি গড়েছিলেন তামিম-ইমরুল।সৌম্যর বিদায়ের এক ওভার পরই বাউন্ডারি দিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের ৩০তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে সৌম্যকে হারানো দুঃখটা ভুলেছেন তামিম। তারপরও সৌম্যর কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলে তো মন্দ হয়না! সেই উপলক্ষ করে দেয় বৃষ্টি। তাতে বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। তাতে তামিম ৫৭ ও অভিষেক হওয়া লিটন ৩ রান নিয়ে সাজঘরে বৃষ্টি বিরতির কারনেই ফিরেন।
এরপর মাঠ রক্ষার পরীক্ষায় নেমে পড়েন গ্রাউন্ডসম্যানরা। ২৫-৩০ মিনিট বৃষ্টি হবার পর, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ খেলার উপযোগী করে তুলেন মিরপুরের গ্রাউন্ডসম্যানরা। ফলে বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে আবারো মাঠে গড়ায় বাংলাদেশ-ভারত ব্যাট-বলের লড়াই।সেই লড়াই এবার অসহায়ত্ব দেখিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। ১৮ ওভারের তৃতীয় বল থেকে ২৪ ওভারের তৃতীয় বল পর্যন্ত দলের সেরা তিন ব্যাটসম্যানকেই হারিয়ে ফেলে স্বাগতিকরা। এসময় ২৩ রানের মধ্যে মধ্যে ফিরেন তামিম, লিটন ও মুশফিকুর। তামিম ৭টি চার ও ১টি ছক্কায় ৬২ বলে ৬০, লিটন ৮ ও মুশফিকুর ১৪ রানে আউট হন।অপয়া বৃষ্টির কারনে ৪ উইকেটে ১৪৬ রানে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের রানকে এরপর সামনের দিকে টেনেছেন সাকিব আল হাসান ও সাব্বির রহমান। ভারতীয় বোলারদের কিছুটা সমীহই করে খেলেছেন তারা। তবে তাতে রান তোলায় ভাটা পড়েনি। ঠিকই স্কোর বোর্ড হেটেছে শক্তপোক্ত হবার পথে।তবে সেই শক্তপোক্তের পথে বাধাঁ হয়ে দাড়ান ভারতের স্পিনার রবীন্দ্র জাদেজা। হাফ-সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখতে থাকা সাব্বির ৪১ রানে থামেন ঐ জাদেজার বলেই। তার ৪৪ বলের ইনিংসে ৫টি চার ও ১টি ছক্কার মার ছিলো। সাব্বির না পারলেও, হাফ-সেঞ্চুরির কোটা স্পর্শ করেছেন সাকিব। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২৯তম হাফ-সেঞ্চুরি পাওয়া ইনিংসটা অবশেষে থামে ৫২ রানে। মোকাবেলা করা ৬৮টি বলের মধ্যে ৩টি বাউন্ডারি মেরেছেন সাকিব।
সাকিব যখন বিদায় নেন তখন দলের স্কোর ৪৩ দশমিক ৪ বলে ৬ উইকেটে ২৬৭ রান। ফলে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মত দলের স্কোর ৩’শর কোটায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় নাসির হোসেনের কাঁেধ। চেষ্টা করেছিলেন নাসির। কিন্তু পুরোপুরি সফল হননি তিনি। সাত নম্বরে নামা নাসির ৩টি চার ও ১টি ছক্কায় ২৭ বলে ৩৪ রান করে থামেন।তাই আবারো শংকায় পড়ে যায় ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ৩’শ রান। সেই শংকাটা আরও বেশি গভীরতা পায় মাঝে রুবেল ৪ ও তাসকিন ২ রানে ফিরে গেলে। তবে সকল শংকাকে দূর করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি। ইনিংসের শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে বাউন্ডারি হাকিয়ে দলের স্কোর ৩’শ অতিক্রম করান ম্যাশ। শেষ পর্যন্ত দ্’ুবল হাতে রেখেই শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়েছেন মাশরাফি। তার আগে মূল্যবান ২১টি রান করেন তিনি। তার ১৮ বলের ইনিংসে ৩টি চারের মার ছিলো। আর সবক’টি ব্যাটসম্যানের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্কোর বোর্ডে জমা পড়ে ৩০৭ রান। ভারতের পক্ষে অশ্বিন ৩টি, ভুবেনশ্বর ও যাদব ২ট করে উইকেট শিকার করেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর কার্ড :
বাংলাদেশ ইনিংস : ৩০৭/১০, ৪৯.৪ ওভার (তামিম ৬০, সৌম্য ৫৪, সাকিব ৫২, সাব্বির ৪১, অশ্বিন ৩/৫১)।
ভারত ইনিংস : ২২৮/১০, ৪৬ ওভার (রোহিত ৬৩, রায়না ৪০, মুস্তাফিজুর ৫/৫০)।
ফল : বাংলাদেশ ৭৯ রানে জয়ী।
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মুস্তাফিজুর রহমান (বাংলাদেশ)।