দৈনিকবার্তা-লন্ডন, ১৫ জুন, ২০১৫: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে এবং যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে ও যোগাযোগ জোরদারের মাধ্যমে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভৌগলিক গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে জনগণের জীবনমান উন্নত করে দেশের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত করাই আমাদের লক্ষ্য।
এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, যোগাযোগ বাড়িয়ে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মায়ানমার ইতোমধ্যে ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর (বিসিআইএম-ইসি)’ নামক যৌথ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। লন্ডনের পার্ক লেন হোটেলে রোববার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এক সাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে তিনি এসব কথা বলেন। ভারতের সাথে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসামান্য অবদানের জন্য যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ এই সংবর্ধনা সভা আয়োজন করে।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। বিখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীকে প্রবাসী বাংলাদেশী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের দেয়া মানপত্র পড়ে শোনান। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র বেশ কয়েকটি কপি পাওয়ার পর অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের বেশকিছু সংখ্যক সদস্য সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এদের মধ্যে রয়েছেন হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্নের লেবার দলীয় এমপি এবং বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিকী, কার্ডিফ সেন্ট্রালের লেবার দলীয় এমপি জো স্টিভেনস, ইলফোর্ড নর্থের লেবার দলীয় এমপি ওয়েস স্ট্রিং, ইলফোর্ড সাউথের লেবার দলীয় এমপি মাইক গেপস এবং সুতন ও চীপের রক্ষণশীল দলের এমপি পাউল স্কাউলি। এছাড়া অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এমপি, ঝিনাইদাহ’র আওয়ামী লীগ সাংসদ নবী নেওয়াজ, প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে অন্যান্য শহীদ, জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসাবে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভূটান উন্নয়নের স্বার্থে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের অভিন্ন শত্রু হিসাবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর বিরুদ্ধে সকলকে একযোগে লড়াই চালাতে হবে। তিনি বলেন, কেবল নিজেদের নিয়ে ভাবনাটা সঠিক হবে না। আমাদেরকে প্রতিবেশীদের নিয়েও ভাবতে হবে। ভারতের সাথে স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নকে সরকারের বড় ধরনের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ যখন থেকে ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকে একের পর এক সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার মায়ানমার-ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেও আন্তর্জাতিক সাশিলী আদালতে মামলা রজ্জুর মাধ্যমে সমুদ্রসীমা বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করেছি এবং এ আওয়ামী লীগই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বাঙালি জাতির জন্য সম্মান বয়ে আনতে পারে।
স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পটভূমি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিটমহলবাসীদের সমস্যা সমাধানে এ উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, ছিটমহলবাসীদের বহু বছরের পুরনো সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লীতে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে এই চুক্তি অনুমোদন করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের পর পরবর্তী সরকারগুলো এ চুক্তি কার্যকরে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে ভারতের পার্লামেন্ট বহু প্রতীক্ষিত এ চুক্তি অনুমোদন করতো এবং ছিটমহলবাসীদের ভোগান্তির অবসান হতো। তিনি বলেন, ছিটমহলবাসীদের এ সমস্যা সমাধানে জিয়া, এরশাদ, খালেদা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো সাহস করেনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষর এবং কয়েক দশকের পুরনো পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধান করেছে।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিদ্যুৎ ও আইসিটিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৭ শতাংশে হ্রাস করেছে। চরম দারিদ্র্যের হার ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এ ব্যাপারে শিগগিরই সরকারি ঘোষণা দেয়া হবে। শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গত ৬ বছরে ৫ কোটি মানুষ নি¤œবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের দ্রুত উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে আমরা দেশে ২০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করেছি। শেখ হাসিনা বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং দেশের খাদ্য উৎপাদন ৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার টনে পৌঁছেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাঁর সরকার নেপালে ভূমিকম্পের পর তাৎক্ষণিকভাবে ১০ হাজার টন চাল পাঠিয়েছে এবং আরো ১ লাখ টন চাল পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর ফলে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহায়তায় নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তম প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণে উৎসাহিত হয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা এ ব্যাপারে সবসময় সহায়তার আশ্বাস দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি নিজের জন্য কিছু চান না। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে দেশবাসীর কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি দেশের কল্যাণে কাজ করে আসছেন। এ ব্যাপারে দেশবাসীর ভালোবাসা এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের সহযোগিতা তাঁকে উৎসাহ দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অগ্রগতির পথে অনেক বাধা আসবে। কিন্তু আমরা এসব প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে এগিয়ে যাবো। শেখ হাসিনা বলেন, এটা আমাদের চিরকালের অভ্যাস স্রোতের বিপরীতে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা এ ¯্রােতের বিপরীতে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। আমাদের ঝড়-তুফানের মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ রয়েছে। আমাদের উভয় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত চক্রের হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও ও নৈরাজ্যের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এসব বর্বরোচিত কর্মকান্ডের হোতা এখন লন্ডনে বসবাস করছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা এতিমদের অর্থ আত্মসাৎ করেছে এবং বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ নারী-শিশু ও পুরুষকে হত্যা করেছে তারা কখনো রেহাই পাবে না। এসব জঘন্য অপরাধীদের অবশ্যই বিচার করা হবে।