1434218311

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৪ জুন: গত কয়েকদিনে প্রবল বর্ষণে আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে দেশের বিভিন্ন নদনদীগুলোর। কুড়িগ্রাম বগুড়া সিরাজগঞ্জ জামালপুর ও শেরপুর জেলায় বন্যায় নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে ।তাছাড়া নদী ভাঙন ও ভারীবর্ষণে অনেকের বসতবাড়ি নদীগর্ভে চলে গেছে।এদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের ফুলছড়ি পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়ার পানি বিপদসীমা ছুই ছুই করছে। নদ নদীগুলোতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা ও ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে গ্রামবাসীদের মধ্য।পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ভাঙন ঠেকাতে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে,বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে যা আগামী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।ব্রাহ্মপুত্র ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল আগামী ২৪ ঘন্টা পর হ্রাস পাওয়া শুরু করতে পারে এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি আগামী ২৪ ঘন্টা অব্যাহত থাকতে পারে।বগুড়া, সিলেট, জামালপুর ও গাইবান্ধা জেলার কতিপয় অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরি¯ি’তির উন্নতি হতে পারে।পানি উন্নয়ন বোর্ডর ৮৪টি পানি মনিটরিং স্টেশনের মধ্যে ৫০টি স্থানে পানি বৃদ্ধি ও ২৮টি স্থানে পানি হ্রাস পেয়েছে। ৬টি স্থানের তথ্য পাওয়া যায়নি। ৬টি স্থনের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।গাইবান্ধায় ঘাঘট, গালিয়াই তিস্তা, বাহাদুরাবাদের যমুনা, সারিয়াকান্দি যমুনা, সুনামগঞ্জে সুরমা এবং জারিয়াজাঞ্জাইলে কংশ নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।সকাল ৯টা থেকে আগামী ২৪ ঘন্টায় খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় অ¯’ায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।আবহাওয়া চিত্রের সংক্ষিপ্ত সারে বলা হয়েছে, লঘুচাপের বর্ধিতাংশ উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয়। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র দুর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ: কদিনের ভারি বর্ষণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা ডিএনডি বাঁধ প্রকল্পের ভেতরে ব্যাপক জলাবদ্ধতায় বাড়ি-ঘর ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ।ডিএনডি বাঁধের ভেতরে ছোট-বড় প্রায় দুই হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যহত হচ্ছে উৎপাদন। ক্ষেত-খামারে সেচের জন্য ১৯৬৭ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ- ডেমরার বিশাল এলাকা নিয়ে চালু করা হয় ডিএনডি প্রকল্প।তবে প্রকল্পের ভেতরে শিল্প কল-কারখানা, পানি নিষ্কাষণের খাল দখল করে ঘর-বাড়ি নির্মাণ ও অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠায় ময়লা-আবর্জনায় তা সংকীর্ণ হয়ে সামান্য বৃষ্টিতেও তলিয়ে যাচ্ছে পুরো এলাকা। ফলে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতেই এ প্রকল্পের মধ্যে পানি বেড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, অফিস-আদালতে পানি ঢুকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানারোগ।

প্রকল্পের জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনডি পাম্পিং প্ল্যান্ট নতুন কওে তৈরি করতে হবে বলে জানান শিমরাইল পাম্প হাউজের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম সারোয়ার।জলাবদ্ধতা দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি এলাকাবাসীর।গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের তিস্তা এবং গাইবান্ধার যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে এ তিন নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রোববার সকালে থেকে তিস্তা এবং দুপুর থেকে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে।এর ফলে তিস্তার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সলেডি স্প্যার-২ হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া গাইবান্ধা ফুলছড়ির সিংড়িয়া-রতনপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ দুই অংশে ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে।

লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা ও সানিয়াজান নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটে বন্যা দেখা দিয়েছে। তিস্তার পানিতে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে নদী গুলোর পানি বাড়তে শুরু করে। হাতিবান্ধায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারেজ দোয়ানী পয়েন্টে রোববার দুপুরে বিপদ সীমার ১০ সেঃ মি ঃ উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে থাকে । পাউবো সুত্র জানায়, তিস্তা পাড়ের লোক জনের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। ভারত গজল ডোবা ব্যারেজের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ঘর বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছে। প্রচন্ড গতিতে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। আরও কি পরিমাণ পানি আসবে তা ধারনা যাচ্ছে না।

পানি গতি নিয়ন্ত্রন করতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি গেটই খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তার পানিতে বহুল আলোচিত ছিটমহল আঙ্গোরপোতা- দহগ্রাম, হাতিবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সিন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের চর এলাকারসহ জেলার ২০ গ্রামের ১০ হাজার পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। কয়েক হাজার একর আমন ধানের ক্ষেতসহ অনেক ফসলী ক্ষেত তিস্তার পানিতে ডুবে গেছে। হাতিবান্ধা উপজেলার ধুবনী গ্রামে ভেসি বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। এ বাধঁ ভেঙ্গে গেলে তিস্তার পানি হাতিবান্ধা শহরে ঢুকে পডবে। ইতোমধ্যে চর এলাকা গুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে। চর এলাকা গুলো থেকে খবর আসছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। এখন পানি বন্দি পরিবার গুলোর মাঝে কোন খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়নি।

সুত্র জানায়, তিস্তা পানি আরও বৃদ্ধি পেলে তিস্তা ব্যারেজ রক্ষার্থে পাউবো ফ্লাড বাইপাস কেটে দিতে পারে। এ বাধঁ কেটে দিলে গোটা লালমনিরহাট জেলার লক্ষাধিক পরিবার পানি বৃন্দি হয়ে পড়বে। এতে কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হবে। চর ধুবনীর মমতাজ আলী, কিসমত লোহালীর আবু বক্কর, পাটিকাপাড়ার রফিকুলসহ অনেক পানি বৃন্দি পরিবার অভিযোগ করেন, আমরা ২ দিন ধরে পানি বৃন্দি অবস্থায় আছি। এখন পর্যন্ত আমাদের মাঝে কোন ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি। কেউ আমাদের খোঁজ পর্যন্ত করেনি। এদিকে, পানি অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় লালমনিরহাট পাটগ্রাম উপজেলার ছিটমহল আঙ্গরপোতা-দহগ্রামের চর, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, চর হলদীবাড়ি, কালীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম কাশিরাম, চর বৈরাতী, শৈলমারী চর, আমিনগঞ্জ চর ও রুদ্ধেশ্বর চর, আদিতমারী উপজেলার চরগোবর্ধন, দক্ষিণ বালাপাড়া, মহিষাশহর, কুটিরপাড়, চন্ডিমারী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছা, কালমাটি, রাজপুর, তিস্তা ও ধরলা নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো বন্যায় প্লাবিত হয়ে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, পানি বৃদ্ধিতে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নদীর বাম তীরে কয়েকশ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৩টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সলেডি স্প্যার-১, ২ ও ৩।বিশেষ করে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্দ্ধন গ্রামে নির্মিত সলেডি স্প্যার-২ মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে।ওই স্প্যারের নিচে ফুটো হয়ে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। যা ক্রমান্বয়ে বড় আকার ধারণ করছে। ফলে সামনের অংশটি ২ ইঞ্চি বসে গেছে। এতে যেকোনো সময় পুরো স্প্যারটি স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে পারে বলে স্থানীয়দের আশঙ্কা।তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, ভারতের গজল ডোবা ব্যারেজের গেট খুলে দেয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে পানি বৃন্দি পরিবার গুলোর খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে বলে জানান। কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, দুধকুমরসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার সদর, উলিপুর, চিলমারী, রাজিবপুর, রৌমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলার ২৩ ইউনিয়নের নদ-নদীর তীরবর্তী দেড় শতাধিক গ্রাম ও চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবনযাপন করছেন। এ অবস্থায় গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষজন। গ্রামীণ কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। বানভাসী মানুষের এখন একমাত্র ভরসা নৌকা ও কলাগাছের ভেলা। বসতভিটায় পানি ঢুকে পড়ায় উঁচু স্থান ও উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে অনেক পরিবার।সদরের যাত্রাপুর ইউনিয়নের চরযাত্রাপুর গ্রামের সবেদ আলী বলেন, আমরা দিনমজুর। বাড়িত পানি উঠছে। কাজকাম চলছে না। রাস্তা নাই, নৌকাও নাই। ৪ দিন থেকে খুব বিপদে আছি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আমরা এখনো পাইনি।’ উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা চরের মমেনা বেগম বলেন, ‘৪ দিন ধরে বাড়িতে পানি উঠেছে। পানির মধ্যে কোনো রকমে চলাফেরা করতেছি।

রান্না-বাড়া করার খুব কষ্ট হইছে। গরু-ছাগল, ছোওয়া- পোয়া নিয়া খুব কষ্টে আছি বাবা। এখনো কোনো ত্রাণ পাইনি। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, বন্যাকবলিত এলাকার সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহীদের কাছ থেকে বন্যা কবলিতদের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা পেলে দ্রুত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হবে। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যাকবলিতদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। আজই জেলা প্রশাসনে জমা দেওয়া হবে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ১২ সেন্টিমিটার, নূন খাওয়া পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৬ সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সেতু পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি ৬ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে কুড়িগ্রাম সদর, উলিপুর, চিলমারী, রাজিবপুর, রৌমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলার নদ-নদী তীরবর্তী দেড় শতাধিক গ্রাম (চরাঞ্চল) প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২৩টি ইউনিয়নের অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ।গ্রামীণ কাঁচা রাস্তাগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে বর্তমানে চরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা ও কলাগাছের ভেলা।চর ও নিচু এলাকার বসতভিটায় পানি ঢুকতে শুরু করায় অনেক পরিবার উঁচু স্থান বা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। তারা গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে পড়েছে চরম দুর্ভোগে।

কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক এবিএম আজাদ জানান, প্লাবিত এলাকার সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে দুর্গতদের তালিকা চওয়া হয়েছে। তালিকা পেলে দ্রুত ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে।কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, ে রোববার দুপুর পর্যন্ত তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ছয় সেন্টিমিটার ও চিলমারী পয়েন্টে দুই সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। তবে ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ছয় সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নীচে রয়েছে।

নীলফামারী : উজানের ধেয়ে আসা পানিতে ফুলে ফেপে ওঠা তিস্তা ভয়াঙ্কর রুপ নিয়েছে। ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে তিস্তা। এরই মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে তিস্তা পাড়ে। বাড়িঘর ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধ্যানে ছুটছেন। এদিকে রবিবার তিস্তার পানি বিপদ সীমার ২২ থেকে ২৪ সেঃ মিঃ ওঠানামা করে। পাউবোর ডালিয়া ডিভিশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সুরুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তার পরেও তিস্তার উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্তকবস্থায় রাখা হয়েছে। ওদিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির ফলে ডিমলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বিপাকে পড়েছেন, ছোটখাতা, পশ্চিম বাইশপুকুর, পূর্ব বাইশপুকুর, কিসামত ছাতনাই, পূর্বছাতনাই ঝাড়শিঙ্গেরশ্বর, বাঘেরচর, টাবুর চর, ভেন্ডাবাড়ী, ছাতুনামা, হলদিবাড়ী, একতার চর, ভাষানীর চর, কিসামতের চর, ছাতুনামাসহ চরগ্রামগুলোর হাজার হাজার মানুষ। বানের পানিতে এলাকার সমস্ত রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় পানি বন্দি মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। বিশেষ করে গবাদি পশু নিয়ে বানভাসীরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশী বিপাকে। কলার ভেলাই এখন বানভাসীদের একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাড়িয়েছে। অপর দিকে বানভাসীরা পড়েছেন চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। অনেকের হাড়িতে চাল-আটা থাকলেও শুকনো জায়গার অভাবে উপোষ থাকতে হচ্ছে তাদের।

এছাড়াও ছোটখাতা, পশ্চিম বাইশপুকুর, পূর্ব বাইশপুকুর, কিসামত ছাতনাই, পূর্বছাতনাই ঝাড়শিঙ্গেরশ্বর, বাঘেরচর, টাবুর চর, ভেণ্ডাবাড়ী, ছাতুনামা, হলদিবাড়ী, একতারচর, ভাষানীর চর, কিসামতের চর, ছাতুনামা চর প্লাবিত হয়েছে।বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় পানিবন্দি মানুষগুলো কলাগাছের ভেলা বানিয়ে কোনো রকমে চলাচল করছে। টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউএনও) চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম শাহিন জানান, নদীতে বন্যার পানি বৃদ্ধির কারণে নিন্মাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়লেও বেশিক্ষণ পানি স্থায়ী হয়নি। তবে, পানি বাড়তে থাকলে দুর্ভোগ চরমে উঠবে। রোববার সকালে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজাউল করিম ও জেলা ত্রাণ পুনর্বাসন কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম তিস্তা নদীর আশপাশ ইউনিয়নগুলো পরিদর্শন করেন।

রংপুর: ভারীবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।উপজেলার কোলকোন্দ, আলমবিধিতর ও নোহালী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দুশ’ ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।হুমকির মুখে পড়েছে তিস্তা প্রতিরক্ষা ডান তীর বাঁধ, এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দিরসহ কয়েকশ ঘরবাড়ি। ভাঙন আতঙ্কে সেখানকার মানুষ এখন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন।তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় পাঁচশ পরিবার।পানি বৃদ্ধির ফলে এক সপ্তাহ ধরে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়।উপজেলার পাইকান, সাউদপাড়া, চিলাখাল ও মন্দির পাড়া এলাকায় ২০টি পরিবারের ঘরবাড়ি, বসত-ভিটা, আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে।

জুম্মাপাড়া ও চিলাখাল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাইকান আকবরিয়া ইউসুফিয়া শিশু সদন, সাউদপাড়া ইসলামিয়া বহুমূখী ফাজিল মাদ্রাসা, আকবরিয়া ইউসুফিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, একটি পোস্ট অফিস, ১০টি মসজিদ, একটি মন্দিরসহ কয়েক’শ পরিবারের ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি এখন হুমকির মুখে।পাইকান এলাকার বাসিন্দা গোলাম মর্তুজা বলেন, নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে আমরা এখন নিঃস্ব।সাউদপাড়া ইসলামিয়া বহুমূখী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা রোকনুজ্জামান বলেন, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আমাদের এ করুণ অবস্থা। কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকার লোকজনকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভাঙন ঠেকাতে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে পাঁচশ’ বস্তা দেওয়া হয়েছে।এদিকে কাউনিয়া উপজেলায় তিস্তা নদীর ভাঙনের আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন ১৫ গ্রামের মানুষ।ভাঙনের আতঙ্কে উপজেলার পাঞ্জরভাঙ্গা, নিজপাড়ার (একাংশ), ঢুষমাড়া, তালুক শাহাবজ, গনাই, হরিচরণশর্মা, চরগনাই, বিশ্বনাথ, চরআজম খাঁ, বিনোদমাঝি, হয়বৎখাঁ, তাবুরচর গ্রামের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।বাড়িঘর ও আবাদি জমি হারিয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন তিস্তার তীরবর্তী কয়েক গ্রামের শতাধিক পরিবার। বাড়িঘর অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রবাহ বেড়েছে। গোটা বছর খাঁ খাঁ করলেও বর্ষার শুরুতে সামান্য বৃষ্টিতেই দু’কুল ছাপিয়ে বয়ে চলে এ নদ।খননের অভাবে বছরের পর বছর পলি জমে নদটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নদের গতিপথ পাল্টে প্লাবিত হয় নতুন নতুন এলাকা। এতে নদপাড়ের বাসিন্দাদের বাড়ছে দুর্ভোগ।স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত শনিবারের ভারী বর্ষণে এরইমধ্যে শহর রক্ষা বাঁধের ২৫ পয়েন্টে কমপক্ষে ৪০০ মিটার বাঁধ ধসে গেছে। আবারও বর্ষণ হলে এসব ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্ট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। ধস নামতে পারে নতুন নতুন পয়েন্টে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে অব্যাহত পলি পড়ে ব্রহ্মপুত্র মৃতপ্রায় অবস্থায় পরিণত হয়। নদের উৎসমূখে তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদটির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে বিপরীত রূপ দেখা যায় বর্ষাকালে।ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা সোহেল রানা জানান, রোববার ব্রহ্মপুত্র নদের পানির প্রবাহ ৯ দশমিক ৪০ মিটার। যা শনিবার ছিল ৯ দশমিক ৩৬ মিটারে। একদিনে পানির প্রবাহ বেড়েছে ৪ সেন্টিমিটার।১২ দশমিক ৫০ মিটার পানি প্রবাহ থাকলে সেটি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আরেক দফা ভারী বর্ষণ হলেই ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হবে,যোগ করেন তিনি।

এদিকে ময়মনসিংহ শহরকে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন থেকে শহর রক্ষায় প্রায় ১০ বছর আগে পাটগুদাম ব্রিজ মোড় থেকে খাগডহর পর্যন্ত সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বৃষ্টিতে ময়মনসিংহ শহর রক্ষা বাঁধের ২৫ পয়েন্টে ভারী বর্ষণে প্রায় ৪০০ মিটার ধসে পড়েছে।

আরেকবার প্রবল বর্ষণ হলে ধসে পড়া এসব পয়েন্টের মারাত্মক ভাঙনের পাশাপাশি আরও নতুন পয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে’ বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মূসা।সূত্র জানায়, রোববার সকাল থেকে ধসে পড়া ২৫ পয়েন্টের মধ্যে শুধুমাত্র শহরের জয়নুল উদ্যান পার্কের সারিন্দা রেস্টুরেন্টের সামনে ১৫ মিটার বাঁধ পুনরায় মেরামতের কাজ শুরু হয়েছে।এ বিষয়ে ময়মনসিংহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম জানান, এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত সিসি ব্লকগুলো উত্তোলনের কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে ধসে পড়া এ পয়েন্টে বালু ফেলে জিও টেক্সটাইল, খোয়া ও সিসি ব্লক বসানো হবে।পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ মূসা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলোর তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সোমবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে এ তালিকা পাঠানো হবে।প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেলে এসব পয়েন্ট সংস্কার কাজ শুরু হবে বলে জানান তিনি।

সারিয়াকান্দি (বগুড়া): উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ও বৃষ্টির পানিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনা নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। রোববার পর্যন্ত বন্যার পানিতে উপজেলার কাজলা, কর্নিবাড়ী, বোহাইল, চালুয়াবাড়ী, সারিয়াকান্দি সদর ও হাটশেরপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।এরআগে কামালপুর ইউনিয়নের গোদাখালী এলাকায় নির্মাণাধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম বন্যার প্লাবিত হয়।

এদিকে, প্লাবিত এলাকার লোকজন আতঙ্কিত হয়ে বসতবাড়ি ও মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। রোববার দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ড সারিয়াকান্দির উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল মোত্তালেব জানান, গত ১২ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি এক সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৪ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নরসিংদী: গত চারদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে নরসিংদী শহরে এবং জেলার কিছু অংশের জনজীবন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।টানা বৃষ্টিপাতের কারণে শহরে এবং জেলার কিছু অংশের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বিস্তীর্ণ নিচু জমির ফসল এবং সবজি আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।নিরবচিছন্ন বৃষ্টিপাতে মেঘনা নদীতে পানি বৃদ্ধি এবং প্রবল স্রোতের কারণে জেলার সদর ও রায়পুরা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নদী তীরে ভাঙ্গনের দেখা দিয়েছে।নদী ভাঙ্গনের তীব্রতার কারণে ঘর-বাড়ি ও ফসলি জমিসহ সম্পদ হারানোর আতংকের মধ্যে রয়েছেন- জেলার সদর আলোকবালি, বাখেরনগর, রসুলপুর এবং রায়পুরা উপজেলার চর মধুয়া, লক্ষণপুর, মির্জার চর ও নিলাখা গ্রামের অধিবাসীগণ।