দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৭ জুন: রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছ থেকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির পক্ষে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা গ্রহণ করেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।রোববার বেলা একটা ১০ মিনিটের দিকে বঙ্গভবনের দরবার হলে মোদির হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন আবদুল হামিদ।এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দরবার হলে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন বেসামরিক-সামরিক কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
সম্মাননা গ্রহণ শেষে দেওয়া বক্তব্যে মোদি বলেন, অটল বিহারি বাজপেয়ির পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করতে পেরে গর্বিত তিনি।অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক সভাপতি বাজপেয়ির অবদান স্মরণ করেন। বাজপেয়ির মতো ব্যক্তিত্ব ও অকৃত্রিম বন্ধুকে সম্মানিত করতে পারা গর্বের বিষয় বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।বাজপেয়িকে সম্মাননা দেওয়া-সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাজপেয়ি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ওই সময় ভারতীয় জনসংঘের সভাপতি এবং লোকসভার সদস্য হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং মুজিবনগর সরকারকে সমর্থন দেওয়ার জন্য তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে দাবি জানান। তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সত্যাগ্রহ আন্দোলন ও প্রতিবাদ র্যালির আয়োজন করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন তিনি।রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে বেলা পৌনে ১২টার দিকে বঙ্গভবনে যান মোদি।
তাঁকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান রাষ্ট্রপতি।রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রোববার বঙ্গভবনে বাজপেয়ীর এই সম্মাননা তুলে দেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে।অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, শ্রী বাজপেয়ীর যোগ্য উত্তরসূরি এবং বাংলাদেশের আরেক বন্ধু শ্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে সম্মাননা স্মারকটি হস্তান্তর করতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত।পূর্বসূরির হয়ে সম্মাননা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেন,আজ আমার জন্য এক সৌভাগ্যের মুহূর্ত। ভারতবাসীর জন্য এক গৌরবের মুহূর্ত।অটল বিহারী বাজপেয়ী, যিনি আমার মতো অনেকের জন্য প্রেরণা, এমন ভারতরতœকে আজ বাংলাদেশ সম্মানিত করছে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের যে সৈনিকেরা জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের সবাইকে বাংলাদেশ সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে রাষ্ট্রপতি হামিদ তার বক্তৃতায় জানান।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা সম্মাননা দেওয়া হয় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে।২০১২ সালের ২৫ জুলাই ইন্দিরার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর হাতে সেই সম্মাননাপত্র তুলে দেওয়া হয়।এক বছর আগে দায়িত্ব নেওয়ার পর শনিবার প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন নরেন্দ্র মোদী। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত এবং বাজপেয়ীর পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা নিতে তিনি বঙ্গভবনে আসেন রোববার দুপুরে।
রাষ্ট্রপতি নিজে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বঙ্গভবনে অভ্যর্থনা জানান। বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল হলে তাদের সৌজন্য সাক্ষাত হয়। এরই মধ্যে বঙ্গভবনে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গভবনের দরবার হলে সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি যখন পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সে সময় ভারতকে পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ।রাজনীতিবিদ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে শ্রী বাজপেয়ীর অকুণ্ঠ সমর্থন ভারতীয় রাজনৈতিক মহলকে আমাদের স্বাধীনতার সপক্ষে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সে সময় তিনি যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন সেগুলো আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে বিশেষ অবদান রেখেছিল।বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব সময়ই বাজপেয়ীর সহমর্মিতা ও সহযোগিতা পেয়েছে।
তিনি যখন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনও তার প্রমাণ মিলেছে।একজন মহৎ ব্যক্তি এবং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুকে সম্মানিত করার মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্মানিত করছি।১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ভারতের মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে বাজপেয়ীর জন্ম। ভারত ছাড় আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে তারুণ্যেই তাকে কারাগারে যেতে হয়।ভারতীয় জনসংঘে যোগ দেওয়ার পর ১৯৬৮ সালে এ সংগঠনের সভাপতি হন বাজপেয়ী। ১৯৮০ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠনেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এবং প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।বাজপেয়ীর সেই বিজেপিই এখন ভারতের ক্ষমতায়, নরেন্দ্র মোদী সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রী।অটল বিহারী বাজপেয়ী ভারতের সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তার জীবনের অর্ধেকের বেশি সময়। ভারত সরকার ১৯৯২ সালে তাকে পদ্মবিভূষণ’ এবং ২০১৪ সালে ‘ভারতরতœ’ পদকে ভূষিত করে।
২০০৫ সালেরাজনীতিথেকে অবসরে যাওয়া বাজপেয়ী একজন কবি ও বাগ্মী হিসাবেও সুপরিচিত।সম্মাননা অনুষ্ঠানে মানপত্র পড়ে শোনান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।এতে বলা হয়, অটল বিহারী বাজপেয়ী একাত্তরে লোকসভার সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। অরগানাইজার পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বাগত জানান এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানান।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবিতে জনসংঘ ১৯৭১ সালের ১ থেকে ১১ অগাস্ট গণসত্যাগ্রহ এবং ১২ অগাস্ট ভারতের সংসদ ভবনের সামনে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করে।
শ্রী বাজপেয়ী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ এবং এদেশের মুক্তিকামী জনতার সমর্থনে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন।১৯৭২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরে মোদী বলেন, তিনি বলেছিলেন, দেরিতে হলেও, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আমাদের সামনে ইতিহাস বদলের প্রক্রিয়া চলছে। নিয়তি এই সংসদ এবং দেশকে এমন মহান কাজে রেখেছে, যেখানে আমরা শুধুমাত্র মুক্তিসংগ্রামে জীবন দিচ্ছি না বরং ইতিহাসকে একটি পরিণতির দিকে নিতে চেষ্টা করছি।
আজ বাংলাদেশে নিজেদের সংগ্রামের জন্য লড়াই করা মানুষ এবং আমাদের রক্ত একসাথে বইছে। এই রক্ত এমন সম্পর্ক তৈরি করবে যা কোনোভাবে ভাঙবে না। কোনো ধরনের কূটনীতির শিকার হবে না’।নরেন্দ্র মোদী বলেন, আজ এই পবিত্র মুহূর্তে আমাদের এই সংকল্প করতে হবে যেন এ সম্পর্ক অটুট থাকে। বাজপেয়ীজির সম্পর্কের বার্তা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
শারীরিক অবস্থা ভালো থাকলে ৯১ বছর বয়সী বাজপেয়ী নিজেই এ সম্মাননা গ্রহন করতেন এবং তাতে এ আয়োজন আরও পূর্ণতা পেত বলে মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার হাত থেকে এ সম্মাননা নিচ্ছি। এটাই অনেক গৌরবের।বঙ্গবন্ধু, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, তার মেয়ের উপস্থিতিতে এ সম্মান দেওয়া হচ্ছে। মোদী জানান, রাজনীতিতে তিনি অনেক পরে এলেও একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন জানিয়ে জনসংঘের সত্যাগ্রহে তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে।ওই সত্যগ্রহে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে আমি গ্রাম থেকে দিল্লি এসেছিলাম।
… যে গৌরবময় লড়াই আপনারা লড়েছিলেন, যেই স্বপ্নের জন্য, যা প্রত্যেক ভারতীয় চেয়েছিল পূরণ হোক, ওই কোটি স্বপ্নের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন।বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অটল বিহারি বাজপেয়ীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ভারতীয়রা যে স্বপ্ন দেখেছিল, তা ছিল তারও স্বপ্ন।একাত্তরে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীর সমর্থনের কথা স্মরণ কওে রোববার তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ দেয় বাংলাদেশ।রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বাজপেয়ীর এই সম্মাননা তুলে দেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে।অনুষ্ঠানে মোদী বলেন, একটি কথা, হয়তো আমি আগে কখনও বলিনি।
আজ বলতে পেরে আমার গর্ব হচ্ছে। রাজনীতিতে আমি দেরিতে এসেছি, ১৯৯৮ সালের দিকে… কিন্তু অটলজির নেতৃত্বে ভারতীয় জনসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে যে সত্যাগ্রহ করেছিল, একজন যুবকর্মী হিসাবে ওই সত্যগ্রহে একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিতে আমি গ্রাম থেকে দিল্লি এসেছিলাম। যে গৌরবময় লড়াই আপনারা লড়েছিলেন, যেই স্বপ্নের জন্য, যা প্রত্যেক ভারতীয় চেয়েছিল পূরণ হোক, ওই কোটি স্বপ্নের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবিতে ভারতীয় জনসংঘ ১৯৭১ সালের ১ থেকে ১১ অগাস্ট গণসত্যাগ্রহ পালন করে। ওই আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ী।১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরে মোদী বলেন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়, তা ওই বক্তব্যে বোঝা যায়।অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষে বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, যার রচয়িতা একই ব্যক্তি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্মাননা অনুষ্ঠান শেষে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন।