দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৫ জুনঃ বাজেটের আকার নয়, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে চিন্তিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।তাঁদের আশঙ্কা, বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে,এর একটা বড় অংশ অর্জিত হবে না।এমন ঘটলে বাজেটের লক্ষ্য ঠিকমতো পূরণ হবে না।শুক্রবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনা হয়।সেখানে সিপিডির বিশেষ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ কথা জানান।সিপিডির পক্ষে তিনি পর্যালোচনা পাঠ করেন। স্বাগত বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রবৃদ্ধির সোপানে আরোহণের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তার বাস্তবায়ন কঠিন বলে মনে করে সিপিডি।রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে সোপানের পথ পিচ্ছিল হয়ে উঠবে। তাই সোপানের পথটি মসৃণ করতে হবে বলে তাঁরা মত দেন। বাজেটের বিভিন্ন খাতে পাঁচটি কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে সিপিডি।সিপিডির মতে,এবারের বাজেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও ভালো দিক হলো শিশু বাজেট। সবচেয়ে অনুজ্জ্বল হলো ঘোষণা ছাড়া জেলা বাজেট বাদ দেওয়া।
বৃহস্পতিবার জাতীয় বাজেট ২০১৫-১৬ ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বাজেটের পরদিনই সিপিডি শুক্রবার তাঁদের পর্যালোচনা জানাল।এবার বাজেটের আকার দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা।৬ শতাংশের বৃত্তে বন্দী আছে জিডিপি।বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। এবার প্রবৃদ্ধির আকাক্ষা ৭ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যও উচ্চাভিলাষী। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে ৩০.৬২ শতাংশ।অর্থাৎ, নতুন বছরে বেশি দিতে হবে ৪৫,০৭২ কোটি টাকার কর। এই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই শঙ্কায় রয়েছে সিপিডি।জিডিপির তুলনায় বাজেটের আকার আরও বাড়ানো যৌক্তিক মনে করলেও নতুন অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার’ কারণ রয়েছে বলে মনে করে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি।অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, তাতে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ দেওয়া হয়েছে। আর এই ব্যয় মেটাতে দুই লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তিনি।দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যয় নিয়ে আমাদের চিন্তা না, চিন্তা অর্থের উৎস নিয়ে।
বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, এখন যে ব্যয় ধরা হচ্ছে তা বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না। সেই অর্থে একে তথাকথিত উচ্চাভিলাষী বাজেট আমরা বলি না।আমাদের দেশে জিডিপির ১৭ শতাংশ হল রাষ্ট্রীয় ব্যয়। আমাদের সঙ্গে তুলনীয় অনেক দেশ আছে,যারা জিডিপির ২২ শতাংশের উপরে ব্যয় করে। বাংলাদেশও এখানে আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু এটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ কোথা থেকে আসবে তাও বের করতে হবে।বাজেট প্রস্তাবে মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয়ের পরিকল্পনা দেখিয়েছেন মুহিত। এই অর্থের ৬০ শতাংশই আসবে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর থেকে।তবে এই লক্ষ্য অনুযায়ী বাজেটের অর্থায়ন সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান সিপিডির গবেষকরা।মুহিতের বাজেট প্রস্তাবে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি রয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৫ শতাংশ।এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ হিসাবে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি বিদেশি সহায়তা হিসাবে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা পাওয়ার আশার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন,ব্যয় মেটাতে রাজস্ব উদ্বৃত্ত বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে না।ফলে সম্প্রসারণশীল বাজেট দিতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপড় নির্ভরতা বাড়ছে।আবার প্রতিশ্র“ত বিদেশি সহায়তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে এই কাঠামো ভেঙে বের হওয়ার ওপর জোর দেন সিপিডির ফেলো।অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করে যে বাজেট কাঠামো দেওয়া হচ্ছে, তা মন্দাকালীন সময়ে চললেও এটা অব্যাহত থাকতে পারে না। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে সম্প্রসারণশীল মডেল অব্যাহত রাখা কঠিন হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের য লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দেবপ্রিয় বলছেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে হলে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে। আর এটা না করতে পারলে ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা বাড়বে।আর এর আগে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা না থাকায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে আগামী তিন বছর ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকবে বলেও দেবপ্রিয়র ধারণা।মুহিত যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার আকার জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার আকার জিডিপির ১২ দশমিক ১ শতাংশ।এই ব্যয় বেশি না হলেও রাজস্ব আদায় জিডিপির ১৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে বলে মনে করছেন দেবপ্রিয়।প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে সড়ক অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পল্লী উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান।দেবপ্রিয় মনে করছেন, উন্নয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতে আরও বরাদ্দ দরকার।উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারণ ও ‘সঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ না করতে পারারও’ সমালোচনা করেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে নতুন বাজেট নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও বিদায়ী বাজেটের অর্জন নিয়ে পর্যালোচনা থাকে না। বিদায়ী বছরের লক্ষ্য অর্জনের তথ্যও বাজেটে রাখার দাবি জানান তিনি।অর্থায়ন নিয়ে মুহিতের সমালোচনা করলেও রাজস্ব আদায়ে তার বেশকিছু পদক্ষেপের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন দেবপ্রিয়।করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসে কর বাড়ানোরও পক্ষে আমরা। পোশাক রপ্তানির ওপড় উৎসে কর বৃদ্ধিকে যৌক্তিক মনে করলেও চিনির আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব ‘ইতিবাচক হয়নি বলে সিপিডি মনে করে।আর মোবাইল ফোনের সিম বা রিমের মাধ্যমে সেবায় ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব সবার ক্ষেত্রে আরোপ না করে ন্যূনতম একটি ব্যয়সীমা পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়।সিপিডির বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ও রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সময় ধরে চললেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে আলাদাভাবে জেলা বাজেট না দেওয়ারও সমালোচনা করা হয়।তবে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় মনে করেন, বাংলাদেশের সামরিক ব্যয় ভারত বা পাকিস্তানের তুলনায় অনেক কম। বাজেটে আয়-ব্যয় কাঠামো বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে যে প্রাক্কলনগুলো করা হয়েছে, তা করা হয়েছে সংশোধিত বাজেট কাঠামোর ভিত্তিতে।প্রকৃত অর্জনের ভিত্তিতে আয়-ব্যয় কাঠামো করা হয়নি। আরও ৩ মাস পর পরিষ্কার হবে, সংশোধিত বাজেটের ক্ষেত্রে যে মান ধরা হয়েছে তার অর্জন একটু নিচে।সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার হার ধরলে প্রবৃদ্ধি অনেক বেড়ে যাবে। গতবছরও বলা হয়েছে, এ বছর ৩০ হাজার কোটি টাকা অনর্জিত (রাজস্ব ঘাটতি) থাকবে না। আগামী অর্থবছরেও যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে তার একটি বড় অংশ অনর্জিত থাকবে বলে জোর দেন এ অর্থনীতিবিদ।রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ২৭ শতাংশ থেকে ৩৫-৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রবৃদ্ধি গড়ে ৩ বছর ১০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। দেশের প্রয়োজনে দেশীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশজ আয়ের যে ১৭ শতাংশ রয়েছে তা ২০-২২ শতাংশে অবশ্যই নিতে হবে। দেশের ১০-১১ শতাংশ রাজস্ব থেকে আসে। রাজস্ব বাড়াতে সরকার যে সংস্কারের কথা বলেছে, তা দ্রুত করার পক্ষে মত দেন তিনি। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে মনোযোগী হওয়া উচিত। প্রকল্প সাহায্য ব্যবহার হলে এডিপি ব্যবহার বাড়বে, বাড়বে কর্মসংস্থান।
সিপিডির গবেষণা তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, ২০১৬, বড় জোর ২০১৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এর জন্য ২০২১ সালের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রায় প্রভাব পড়বে কি-না? এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক ঐক্যমত থাকলে বাজেট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব।পাঁচটি কমিশন সম্পর্কে দেবপ্রিয় বলেন, পরিসংখ্যান, স্থানীয় সরকার, কৃষি, সরকারি ব্যয় ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার কমিশন করার কথা বলা হয়েছে।আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত সংস্কার বিষয়ে কমিশন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়ন করতে সিডিপি’র পক্ষ থেকে দাবি জানানো হয়।সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।