দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৪ জুনঃ পদ্মাসেতু হতে যাচ্ছে জাতীয় প্রবৃদ্ধির অন্যতম উৎস।এই ঘোষণা দিয়েছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ২০১৮ সালের মধ্যে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেট প্রস্তাবের সময় এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।বাজেট বক্তৃতার ১০৮ নং অধ্যায়ের এই অংশ যখন পড়ছিলেন জাতীয় সংসদে তখন মুহুর্মূহু করতালি পড়ছিলো। সাংসদদের উদ্যেশ্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি যথা সময়ে পদ্মাসেতু নির্মাণে শেষ হবে। আর পদ্মাসেতুর কারণেই বাড়বে দেশের জিডিপি।তিনি বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ অনেকদুর এগিয়ে এনেছি। প্রমত্ত পদ্মার দুই তীরে বাঁধ নির্মাণের কর্মযজ্ঞে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে শুরু হয়েছে নতুন কর্ম চাঞ্চল্য। আশা করছি ২০১৮ সাল নাগাদ যান চলাচলের জন্য এই সেতু উন্মুক্ত করে দিতে পারবো।যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে মোট ২৬ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আজ জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশকালে ওই বরাদ্দের প্রস্তাব করেন।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি সড়ক- সেতু অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন, যাত্রীসেবার মানোয়ন্নন, রেলপথ উন্নয়ন, পদ্মা সেতু নির্মাণ, যানজট নিরসন, বন্দর ও নৌপথ উন্নয়ন, বিমানবন্দর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ খাতে এই বরাদ্দ প্রস্তাব করেছেন।সড়ক-সেতু অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ : দেশের পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার জন্য ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্র“ভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ৬১টি সেতু পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। চলমান আছে ২য় কাঁচপুর, ২য় মেঘনা ও ২য় গোমতী সেতু নির্মাণের কাজ। একই সাথে গলাচিপা, পায়রা ও কচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ অবস্থানে ভবিষ্যতে ২য় পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।সড়ক অবকাঠামোর ক্ষেত্রে জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা মহাসড়ককে ৪ লেনে উন্নীতকরণের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে আমরা নিচের প্রকল্পগুলো সমাপ্ত করা যাবে।ইস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্র“ভমেন্ট প্রকল্প; ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প; বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কে শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং শেখ রাসেতু নির্মাণ; কক্সবাজার- টেকনাফ- মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ ২য় পর্যায় (ইনানী থেকে সীলখালী); যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর সড়ক ৮ লেনে উন্নীতকরণ ও আড়িয়ালখাঁ নদীর ওপর ৭ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ।
এ ছাড়া বাস ট্রানজিট, সড়ক পরিবহন ও ট্রাফিক বিষয়ক বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।বিদ্যমান সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন : মহাসড়ক মেরামত ও সংস্কার, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য ১০টি জেলা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সড়ক, সেতু ও কালভার্ট পুনর্নির্মাণ, প্রশস্বকরণ ও সার্ফেসিংয়ের জন্য ও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।যাত্রী সেবার মানোয়ন্নন : সড়ক পথে যাত্রী সেবার মানোয়ন্ননের জন্য আমরা বিআরটিসির অধীনে ৩০০টি দ্বিতল ও ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস সংগ্রহ করতে হবে। গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ড্রাইভিং ইনস্ট্রাকটর তৈরি করা হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ীর ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানের জন্য অকার্যকর হয়ে থাকা ৫টি মোটর যান পরিদর্শন কেন্দ্র প্রতিস্থাপনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পরিবহনের সমন্বয়ে নিরবচ্ছিন্ন যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে ই-টিকেটিং ক্লিয়ারেন্স হাউস প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাসমূহকে ব্লাক স্পট হিসেবে চিহ্নিত করে ওইসব এলাকার সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।রেলপথ উন্নয়ন : ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে বিশ্বব্যাপী রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। প্রায় একই সময়ে আমাদের দেশেও রেলপথ নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশে এক সময়ে রেলপথ ও জলপথই ছিলো যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম। অধূনা সেই ভূমিকা মূলক সড়ক পরিবহনই গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে জলপথ অনবরত সংকুচিত হয়েছে এবং রেলপথের ব্যবহার ও সংরক্ষণ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
আমরা রেলপথের পুনর্জাগরণের কৌশল গ্রহণ করেছি এবং রেলখাতে যে বিনিয়োগ রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০ বছর মেয়াদী একটি রেলওয়ে মাস্টার প্লাণ গ্রহন করা হয়েছে। যেখানে ২৩৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আমাদের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে দোহাজারী-কক্সবাজার- গুনদুম, কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া- গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া, পাঁচুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা, ঈশ্বরদী-পাবনা- চালারচর এবং খুলনা-মংলা নতুন রেললাইন নির্মাণ/পুনর্নির্মাণ, মেহেরপুর জেলাকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল সার্ভিস চালু করা, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তরে রেল সেতু নির্মাণ, ঢাকা-টঙ্গি সেকশনে ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গি-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটার গেজ রেল লাইনের সমান্তরাল একটি ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ ইত্যাদি। অন্যদিনে, আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আখাউড়া-আগরতলা রেল কানেকটিভিটি স্থাপন করতে যা”িছ আমরা।
পদ্মা সেতু নির্মাণ : নিজস্ব অর্থায়নে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ অনেক দূর এগিয়ে এনেছি। প্রমত্তা পদ্মা দুই তীরে বাঁধ নির্মাণের কর্মযজ্ঞে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে শুরু হয়েছে। নতুন কর্মচাঞ্চল্য। আশা করা যাচ্ছে ২০১৮ সাল নাগাদ এই সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারবো।যানজট নিরসণ : যানজটমুক্ত ঢাকা শহর গড়ে তুলতে মেট্রো রেলের কাজ শুরু করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে ২০১৯ সাল নাগাদ এর কাজ শেষ করা যাবে। যানজট সমস্যা সমাধানে আমাদের চলমান অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে ৩৮ দশমিক ২ কিলোামিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা শহরে জাহাঙ্গীরনগর গেইট এলাকায় ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। এ ছাড়া গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত এবং বিমানবন্দর থেকে ঝিলমিল পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের রুট সমীক্ষা এবং প্রাথমিক নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্রুতগতিতে চলছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো যে, রাজধানীর যানবাহন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বতন্ত্র সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে। কর্নফুলি নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের জন্য চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানী লিমিটেডের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে। এটি নির্মিত হলে চট্টগ্রামের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সংযোগ বাড়ার পাশাপাশি যানজট হ্রাস পাবে।
বন্দর ও নৌপথ উন্নয়ন : ফাস্ট ট্রাকভুক্ত পায়রা বন্দর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রস্তুতিপর্বে নিজস্ব অর্থায়নে বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মংলা বন্দর উন্নয়নে কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডালিং যন্ত্রপাতি সংগ্রহে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর জিটুজি ভিত্তিতে স্থাপনের জন্য কতিপয় বন্ধু দেশ অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া নৌপথের নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য মাদারীপুর-চরমুগুরিয়া- টেকেরহাট- গোপালগঞ্জ নৌপথ খনন এবং অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাপিটাল পাইলট ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় উদ্ধারকৃত এলাকায় সিরাজগঞ্জ শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।বিমানবন্দর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা ও সেবা সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানের যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা ও সেবার মান বাড়াতে বিমান বহরে নতুন প্রজন্মের বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ সংযোজনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া খানজাহান আলী বিমানবন্দর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে।