Rajshahi_sm_181444222

দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ০৪ জুন: রিকশা চালক আজিজুল ইসলাম। বাড়ি নওগাঁর পতিœতলা। রাজশাহী নগরীর ছোট বনগ্রাম এলাকার একটি বস্তিতে ভাড়া থাকেন স্ব-পরিবারে। আজ সকালে তিনি রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার এলাকায় ভ্যানে করে বিক্রি করা লটারির টিকিট কেনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। কেন টিকিট কিনছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে আজিজুল বলেন, দেখি আজকে কিছু পাই কি না। গত কয়েকদিন ধইরেই তো কাটছি। তবে কিছুই কপালে জুটেনি। আজ আবার ক্যাটছি। যদি পাই সে আশায়।’

আজিজুল বলেন, সকালে দুই মুঠ খ্যায়ে বের হইছি। কয়েক খ্যাপ ম্যারে টাকা হইছে ৯০ টা। এখন চারড্যা লটারির টিকিট কিনব ‘তিনি আরও জানান, যেদিন একটু বেশি আয় হয়, সেদিন আরও বেশি টিকিট কাটেন তিনি। শুধু বড় কিছু পাবার আশায়। যেন রাতারাতি লাখোপতি হতে পারেন। এটি করতে গিয়ে গত ১৫ দিনে প্রায় অন্তত আড়াই হাজার টাকার টিকিট কেটেছেন তিনি।

অথচ এই কয়দিনে তার আয় হয়েছে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার টাকা। এর মধ্যে রিকশার জমা খরচ দিতে হয়েছে আরও ৬০০ টাকা। ফলে লটারির টিকিট ও রিকশার জমা খরচ বাবদই তার বেশিরভাগ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এর বাইরে আছে পকেট খরচ। এতে করে বাকি টাকা দিয়ে তার সংসারই এখন চালোনো আরও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় গত কয়েকদিনে তাকে অন্যের নিকট থেকে ধার-দেনা করতে হয়েছে আরও প্রায় দেড় হাজার টাকা। কিন্তু তারপরেও মাস শেষে এখন আর ঘর ভাড়া দেড় হাজার টাকায় জুটছে না আজিজুলের। তারপরেও টিকিট কেনার লোভ তার মাথা থেকে যায়নি। আজিজুলের ভাষায়, টিভিতে দেখানো হচ্চে অনেকেই হুন্ডা পাচ্ছে। টাকাও পাচ্ছে। হয়তো আমিও পাতে পারি। তাই টিকিট কাটছি। কিন্তু এই গরিবের কপালে কি আর আছে, যে পাবো।’

তাহলে লটারির টিকিটের পেছনে ছুটছেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তার ফের সাফ জবাব, ’যদি পাই। তাই।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু রিকশা চালক আজিজুলই নন, তার মতো রাজশাহী নগরীসহ জেলা এবং আশেপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার লাখ লাখ মানুষ ছুটছেন নগরীতে চলা মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার র‌্যাফেল ড্র এবং নগরীর নওদাপাড়া বাস্ট্যান্ড দখল করে চলা মাসব্যাপী আনন্দ মেলার নামে র‌্যাফেল ড্র-এর টিকিটের পেছনে। আর এসব খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত মানুষরাও ছুটছেন প্রলোভনের ওই লটারির পেছনে। ফলে দুটি স্থানের লটারি কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন অন্তত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর লোক দেখানো ড্র-এর নামে কিছসংখ্যক পুরস্কার দিয়ে প্রতারিত করছে লাখ লাখ মানুষকে। এভাবে গোটা রাজশাহী অঞ্চলকে পঙ্গু করে দিচ্ছে দুটি মেলা।

সেই সঙ্গে চলছে হাউজির মাধ্যমে জুয়া। এখানেও প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার খেলা হচ্ছে। রাজশাহী নগরীর কালুর মোড় এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, তার বাড়ির কাজের মেয়ে ৫ হাজার টাকা সুদের ওপর নিয়ে মেলার টিকিট কাটছেন প্রতিদিন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কপালে কিছুই জোটেনি। তারপরেও টিকিট কেনার নেশা যায়নি তার মাথা থেকে। এদিকে র‌্যাফেল ড্র-এর টিকিট কেনাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার রাতে নগরীর ছোট বনগ্রাম এলাকায় স্বামীর হাতে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছেন। ওই গৃহবধূর নাম কুমকুম বেগম। তিনি একই এলাকার রফিজ উদ্দিনের স্ত্রী।

তাঁর স্বামীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে মেলার টিকিট কিনে কিছুই না পাওয়াকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এরই একপর্যায়ে শনিবার রাতে আত্মহত্যা করেন কুমকুম বেগম। এইভাবে জুয়ার টাকা নিয়ে নগরীসহ গোটা জেলা আশেপাশের জেলাগুলোতেও দেখা দিয়েছে পারিবারিক কলোহ থেকে শুরু করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এদিকে নগরীর দুটি স্থানে মাসব্যাপী মেলার নামে জুয়ার আসর বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। কিন্তু প্রশাসন এখনো এ বিষয়ে নিরব ভূমিকা পালন করছে। এ নিয়ে নগরবাসীর মাঝে মাঝে দেকা দিয়েছে চরম ক্ষোভ।

এদিকে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতির মাধ্যমে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম-উল আযীমসহ ৭ কাউন্সিল নগরীর কালেক্টরেট মাঠ ও নওদাপাড়া বাসস্ট্যান্ড দখল করে বসানো অবৈধ জুয়ার আসর বন্ধের দাবি জানান।এর আগে ওইদিন সকালে থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত নগরীর কোর্ট শহীদ মিনারে ফুটবল লীগের দাবিতে প্রতিকী অনসন পালনকারীরাও একই দাবি জানান। কিন্তু আজও অব্যাহত রয়েছে এই জুয়ার আসর। আজ প্রতারিত করা হচ্ছে লাখ লাখ মানুষকে।

প্রসঙ্গত, গত ২২ মে থেকে নগরীর নওদাপাড়া বাস্ট্যান্ড দখল করে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নিজস্ব হাসপাতাল চালুর নামে মাসব্যাপী আনন্দ মেলা শুরু হয়। কিন্তু এখানে চলছে অশ্লীল নৃত্য হাউজি এবং লটারির নামে অবৈধ জুয়ার আসর। এর আগে গত ৫ মে থেকে নগরীর কালেক্টরেট মাঠে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার নামে শুরু হয়েছে অবৈধ লটারি ও হাউজি খেলার নামে জুয়ার আসর। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নগরীর উপপুলিশ কমিশনার সদর তানভির হায়দার চৌধুরী বলেন, দুটি আসরেই জুয়া চলছে। কিন্তু যারা এর আয়োজক তারাই এগুলো করছে। এখানে পুলিশের কোনো সংশ্লিষ্টতা নাই।