দৈনিকবার্তা-ভোলা, ০৩ জুন: দক্ষিনাঞ্চলের নদী বেষ্টিত দ্বীপ জেলা ভোলা। সামপ্রতিক সময়ে উপজেলা পর্যায়ে শহর সমপ্রসারিত হলেও যোগাযোগ, আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশে যুগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এখনও কাংখিত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে এখানে। তবে এই জেলার জীবনেই শুধু নয়, এখানকার গ্রামীণ জীবনেও তথ্য প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক নির্ভরতা বেড়েছে। সেই সাথে অদক্ষ শ্রমজীবি মানুষের মাঝে এবং কৃষি সেক্টরে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরুপ প্রভাব ফেলছে এবং নাগরিক জীবনে এনেছে স্থবিরতা। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা সহ ২০ ইউনিয়নের ২৪ টি চরাঞ্চলের সাথে জেলা উপজেলা সদরের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। যা বৈঠা, লগি মেরে দাড় টেনে এবং পাল খাটিয়ে চালাতো নৌকার মাঝিরা। সেই মন্থর গতির নৌকার স্থান দখল করেছে এখন শ্যালো ইঞ্জিন চালিত দ্রুত গতির নৌকা। এতে যাতায়াতে গতি পেলেও বেকার হয়েছে নৌকার মাঝিরা।
শহর এলাকায় যাত্রীবাহী ব্যাটারী চালিত গাড়ী টেম্পু, মাইক্রো এবং মালামাল পরিবহনের ট্রাক এখন জীবনের যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের প্রধান বাহন। এক সময়ের ভোলা থেকে গরুর গাড়ী, রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ী উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। জেলা উপজেলা সদরেই শুধু নয়, বড় বড় হাট-বাজারগুলোতে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তথ্য প্রযুক্তি সেন্টার। মামলার আরজি লেখা, অভিযোগ, ফরম সংগ্রহ, পরীক্ষার ফলাফলসহ নানা আবেদন পত্র দাখিলে কম্পিউটার, ই-মেইল ও বিভিন্ন ওয়েব সাইড ব্যবহারে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে মানুষ। হাতে লেখা এবং টাইপ করা দরখাস্ত, মামলার আরজি লেখা এখন বিলুপ্ত। যে কারণে বিপুল সংখ্যক পেশাজীবি টাইপিষ্ট পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে কম্পিউটার শিখে। কৃষি জীবনে জমি চাষে গরুর টানা লাঙল ও মই এখন আর চোখে পড়ে না। স্থান দখল করেছে কলের লাঙল ট্রাক্টর। আর হোচা ডোংগায় জমিতে জল সেচের দিন শেষে স্থান পূরণ করেছে শ্যালো মেশিন।
ধান কাটা, ঝাড়া, মাড়াই এবং জমিতে চারা রোপন, নিড়ানী এখনও শ্রম নির্ভর হলেও কৃষকের ভোগান্তি এতে বেড়েছে। মৌসুম সময়ে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগে উচ্চহারে মজুরী প্রদান এবং শ্রমিকের অভাবে যথাসময়ে ফসল কেটে মাড়াই করে গোলাজাত করতে কৃষকদের দুর্ভোগের কবলে পড়তে হয়। সে কারণে ধান কাটা, নিড়ানী এবং মাড়াইয়েও যন্ত্রের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হচ্ছে কৃষিজীবিরা। এ প্রবণতা সময়ে এ জেলার কৃষি শ্রম নির্ভর বিপুল সংখ্যক ভূমিহীন প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে বিপাকে ফেলবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সড়ক নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতিতে নিম্নমানের ভাঙ্গাচোরা সড়ক এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলদারিত্বে অপ্রশস্থ সড়ক মফস্বল জনগোষ্ঠির যাতায়াতকে বিপন্ন করে তুলেছে। সীমাহীন যানজটে শুধু জন দুর্ভোগ নয়, বৃদ্ধি পেয়েছে সড়ক দুর্ঘটনাও। সড়কে প্রয়োজনীয় সেতুর অভাবে এখনও যাতায়াত বিঘিœনত অনেক এলাকা রয়েছে এই ভোলায়। এছাড়া কাঁচা মাটির সড়কও নেহায়েত কম নয়। যা শুধু যাতায়াত নয়, মালামাল পরিবহন ও ব্যবসা বাণিজ্য সমপ্রসারণের অন্যতম অন্তরায়।
ভোলার স্থানীয়রা জানায়,সেবা বঞ্চিত উন্নত এবং সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবায় বিপন্ন এখানে মানবজীবন। চরাঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠির জন্য ন্যূনতম চিকিৎসা সুবিধাও নেই। জেলা উপজেলা পর্যায়ের সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শুধু নয় সাধারণ চিকিৎসক, জনবল, বেড এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ সংকট অত্যন্ত প্রকট। ছোটখাটো অপারেশন করারও সুযোগ নেই। বেসরকারী ক্লিনিকগুলোতে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন ছাড়া সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসে না।জরুরী এবং জটিল রোগের চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা না থাকা এই শহরের অন্যতম মানবিক সমস্যা। সুষ্ঠু চিকিৎসা নিয়ে মানুষকে জীবন বাঁচাতে ছুটতে হয় পার্শ্ববর্তী বৃহত্তর জেলা বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়তো ঢাকায়। এক্ষেত্রে অতিদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর পথযাত্রী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ও উন্নত শিক্ষার সুযোগ পায় না এ জেলার শিক্ষার্থীরা। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে পাঠদানের পরিবর্তে অবৈধ প্রাইভেট বাণিজ্য অধিক মনোনিবেশ করায় শিক্ষার্থীরা এদের হাতে জিম্মি। সেই সাথে অবাধে চলছে কোচিং বাণিজ্য যা যথেষ্ট মানসম্মত তো নয়ই বরং প্রচার প্রচারণার আড়ালে এদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে শিক্ষার্থীরা অর্থ এবং তাদের শিক্ষা জীবনকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে প্রতিনিয়ত। জেলা উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, হাট-বাজারে কেনাকাটার প্রাণচাঞ্চল্য নির্ভর করে মূলত গ্রামগঞ্জ থেকে আসা ক্রেতাদের উপর। এই নির্ভরশীলতার কারণে শহরের দোকানপাট খোলে । সকাল দশটার আগে ব্যস্ততা বাড়েনা, জেগে ওঠেনা শহর। আবার একই কারণে রাত নয়টার আগেই নিষ্প্রাণ হয়ে আসে শহুরে জীবন। উপজেলা শহরগুলোতে অবস্থা আরো করুণ।এ কারণে বিনোদনহীন এই শহরের নাগরিক জীবনে এখন বিরাজমান এক ধরণের স্থবিরতা, অর্থনৈতিক বিপন্নতা আর কর্মসংস্থানের সংকটজনিত বেকারত্বের হতাশা।