দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০৩ জুন: পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)’র ২য় গ্র্যান্ড কনভেনশনের উদ্বোধনী দিনে গত ৩০ মে সংগঠনের বিগত আড়াই বছরে সম্পাদিত সাংগঠনিক কার্যক্রমের বিবরণ তুলে ধরে বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করেন মহাসচিব কাজী এনায়েত উল্লাহ। অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন হিসেবে ধীরে হলেও সুনিশ্চিতভাবে সাংগঠনিক ভিত মজবুত হচ্ছে বহুল আলোচিত এই আন্তঃদেশীয় সংগঠনের। বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশী বিশেষ করে ইউরোপে বসবাসরত প্রায় এক মিলিয়ন বাংলাদেশীদের জন্য আয়েবা সেক্রেটারি জেনারেলের সাংগঠনিক প্রতিবেদন হুবহু নিম্নে সন্নিবেশিত হলো –
“ইউরোপে প্রথমবারের মতো আলোর মুখ দেখা তথা নতুন ধারার এক ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)। প্রায় এক মিলিয়ন বাংলাদেশী অধ্যুষিত ইউরোপে এটাই প্রথম কোন আন্তঃদেশীয় অরাজনৈতিক ও অলাভজনক সংগঠন। আয়েবা ইউরোপের ৩০টি দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্মিলিত সংগঠন হলেও আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকেই এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের ১২ অক্টোবর ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আত্মপ্রকাশের পর সাংগঠনিক পথ পরিক্রমায় ২০১২ সালেরই ডিসেম্বরের ১ ও ২ তারিখে এথেন্সে অনুষ্ঠিত হয় আমাদের প্রথম মহাসম্মেলন।
আমাদের অনেকেরই সেদিন সৌভাগ্য হয়েছিল গ্রীসের প্রথম গ্র্যান্ড কনভেনশনে উপস্থিত থেকে ইতিহাসের স্বাক্ষী হবার। মহাসচিবের দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার প্রারম্ভে আমি লাল-সালাম জানাচ্ছি আমাদের বীর শহীদদের, যাঁরা বায়ান্নতে মাতৃভাষা বাংলার জন্য এবং একাত্তরে লাল-সবুজ পতাকার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন। রুহের মাগফেরাত কামনা করছি আমাদের সবার প্রিয় শহিদুল আলম মানিকের স্মৃতির প্রতি, যিনি এথেন্স কনভেনশনের মধ্যমনি হলেও আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ইউরোপ আসার স্বপ্নে বিভোর সেই সকল হতভাগ্য বাংলাদেশীদের আত্মার শান্তি কামনা করছি, যাঁরা স্বপ্ন পূরণের আগেই ভূমধ্যসাগরে হারিয়ে গিয়েছেন চিরতরে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশী সহ বিভিন্ন দেশের সহস্রাধিক অভিবাসী সাগরে সলিলসমাধির শিকার হওয়ার প্রেক্ষিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুটিকে লাইমলাইটে রাখতেই এবারের আয়েবা গ্র্যান্ড কনভেনশনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় আমরা নির্ধারণ করেছি ‘সেইফ মাইগ্রেশন এন্ড হিউম্যানিটি’ তথা ‘নিরাপদ অভিবাসন ও মানবিকতা’।
২০১২ সালে গ্রীসে প্রথম গ্র্যান্ড কনভেনশনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘ইউনিটি ফর প্রগ্রেস’। প্রবাসে কমিউনিটির উন্নয়ন বলি আর বাংলাদেশের অগ্রগতির কথাই বলি, কি দেশে কি বিদেশে ‘ইউনিটি’ বা একতার বিকল্প নেই, এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে বহুদাবিভক্ত আজ ইউরোপের দেশে দেশে বাংলাদেশ কমিউনিটি। ইউরোপের যেখানেই বাংলাদেশ কমিউনিটি আছে সেখানেই দ্বিধা-বিভক্তির এই ‘ভাইরাস’ বছরের পর বছর ধরেই ব্যাহত করে চলেছে কমিউনিটির অগ্রযাত্রা। ফলে ‘ইন্টিগ্রেশন’ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারে বারে। ‘ইন্টিগ্রেশন’ শব্দটি অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন আয়েবা’র মনোগ্রামের শোভা বর্ধন করলেও দেশে দেশে বহু ভাগে বিভক্ত বাংলাদেশ কমিউনিটির সাথে কাজ করতে গিয়ে আমাদেরকে শুরু থেকেই অনেক কৌশলী হতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ‘কান্ট্রি কমিটি’ গঠন প্রক্রিয়ায় মাঠ পর্যায়ে অগ্রগতি হলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি যৌক্তিক কারণেই বিলম্বিত হচ্ছে এক্ষেত্রে। সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আজ আশ্বস্ত করতে চাই, গত দুই বছরে আমাদের করা গ্রাউন্ডওয়ার্কের ‘দৃশ্যমান অগ্রগতি’ নিশ্চিত হবে চলতি ২০১৫ সালের মধ্যেই।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন (আয়েবা) ‘নন-স্টপ এন্ড ফ্রি অব কস্ট’ সার্ভিস দিয়ে এসেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশী ভাই-বোনদের। সাফল্য হিসেবে বলতে চাই না, তবে আয়েবা সবচাইতে বড় দায়িত্বটি পালন করেছে ২০১৩ সালে গ্রীসের প্রত্যন্ত গ্রামে স্ট্রবেরি খামারে মালিক কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশী কর্মী তথা আমাদের মেহনতী ভাইদের ওপর নির্বিচারে গুলীবর্ষণ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেদিন গর্জে উঠেছিলাম আমরাও।
আয়েবা সদর দফতর হিসেবে প্যারিস থেকে যা যা করণীয় ছিল, সবই দ্রুততার সাথে করা হয় তখন। গুলীবর্ষণে আহত অবৈধ বাংলাদেশীদেরকে যাতে ‘স্টে পারমিট’ দিয়ে বৈধ করে নেয়ার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়, সেজন্য প্যারিসে অবস্থিত গ্রীক দূতাবাসে দেয়া হয় স্মারকলিপি। একই সময় ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান কমিশনে দায়িত্বশীল পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সাথে আমার বৈঠকে ইস্যুটি আমি উত্থাপন করি এবং তাঁরা এটিকে ‘প্রায়োরিটি’ হিসেবে দেখার আশ্বাস দেয় তখন। আয়েবার সম্মানিত সভাপতি যেহেতু একাধারে গ্রীসের বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রাণপুরুষ, তাই তিনিও সাধ্যমতো সব কিছুই করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত তথা আহত-নির্যাতিত বাংলাদেশীদের পাশে দাঁড়াতে। ছয় মাসের মাথায় আহত বাংলাদেশীদের বৈধতা দান করে গ্রীক সরকার। তাঁদের আনন্দের সাথে তাই আজ অংশীদার অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন (আয়েবা)।
বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে বিদেশ বিভুঁইয়ে অনুপমভাবে তুলে ধরতে আয়েবা নেতৃবৃন্দ যাঁর যাঁর দেশে সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে কাজে লাগিয়েছেন স্বীয় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতাকে। বিভিন্ন দেশের প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তিদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে তাঁরা প্রবাসে বাংলাদেশের ‘ইমেজ বিল্ডিং’-এর কাজটি করেছেন সুচারুভাবে। শেকড়ের সন্ধানে নতুন প্রজন্মকে সঠিক পন্থায় গাইড করতেও আয়েবা নেতৃবৃন্দ নিরলস পরিশ্রম করেছেন দেশে দেশে। তাঁদের নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় বহু বাংলাদেশীর যেমন বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে, পাশাপাশি অবৈধ বাংলাদেশীরাও সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছেন আমাদের কাছ থেকে। আগ্রহী বাংলাদেশীদেরকে পেশাগতভাবে দক্ষ করে তোলার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রফেশনাল ইনস্টিটিউটের সাথে তাদের সম্প্রক্ততা বাড়াতেও কাজ করেছেন আয়েবা নেতৃবৃন্দ। স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশীদের লাশ দেশে প্রেরণ সহ কমিউনিটির বিভিন্ন চ্যারিটি কার্যক্রমে আমরা সংশ্লিষ্ট দেশে যার যার অবস্থান থেকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছি। দেশে দেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃবৃন্দের সক্রিয় অংশগ্রহনের পাশাপাশি প্রবাসীদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশ সরকার সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রশাসনের সাথে ফলপ্রসু যোগাযোগের ভিত্তিতে কাজ করেছে ইউরোপের সাড়া জাগানো সংগঠন অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)।
কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নেরও স্বার্থক অংশীদার অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসেসিয়েশন (আয়েবা)। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি পরবর্তী বাংলাদেশের তৈরী পোষাক শিল্প যখন ইউরোপের বিশাল বাজারে হুমকির মুখে, তখন প্যারিসের ‘আয়েবা হেড অফিস’ থেকে ফ্রান্স-জার্মানী সহ ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে কর্মকর্তা পর্যায়ে জোরালো লবিং চালিয়ে যাওয়া হয় বাংলাদেশের প্রধান এই রফতানী খাতের স্বার্থরক্ষায়। ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশী পন্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধার ওপর যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তুতি চলছিল, ঠিক তখনই ইইউ’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে আমি জোর দাবী জানিয়েছিলাম আমাদের অবস্থানের স্বপক্ষে।
আয়েবা নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতায় প্রবাসীদের ন্যায্য দাবীদাওয়া ইতিমধ্যে স্থান পেয়েছে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এমনকি বঙ্গভবনেও। আমাদের সরাসরি কার্যক্রম ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও নেটওয়ার্কিংয়ের ভিত্তিতে এর প্রচার ও প্রসার ইতিমধ্যে বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝেও। সাম্প্রতিক সময়ে জাপান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ব্রাজিলে আমার ব্যক্তিগত সফরের সময় ঐসব দেশের কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ আয়েবা’র অগ্রযাত্রার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং প্রবাসীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের বন্ধুর পথচলায় বিশ্বব্যাপী একসাথে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পথে সুনিশ্চিতভাবেই এগিয়ে চলেছে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা)।”