দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১ জুন: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগতি মানেই উন্নয়ন নয় এতে সামাজিক বৈষম্য কমে না- এ মন্তব্য করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।বর্তমান পুঁজি ব্যবস্থায় দারিদ্র্য নিরসন ও বেকারত্ব দূর করা যাচ্ছে না এ কথা উল্লেখ করে এ অবস্থায় সবাই মুনাফা চায় বলেও মনে করেন তিনি।আয় ও সম্পদের ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকলে উন্নয়ন সম্ভব নয় এজন্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।কইসঙ্গে সৃজনশীল সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। সোমবার দুপুরে মিরপুর-১৪ পুলিশ স্টাফ কলেজ কনভেনশন হলে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সোশ্যাল বিজনেস একাডেমিয়া-২০১৫’ শীর্ষক সম্মেলনটির আয়োজন করে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউনূস এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘নট পার্সোনাল, নাও ইম্পর্টেন্ট- পিপলস অ্যান্ড প্লানেটস প্রফিট- ব্যক্তিগত স্বার্থ বা মুনাফা শুধু নয়, এবার গুরুত্ব দিতে হবে মানুষ ও পৃথিবীর স্বার্থে। প্রথম পি দিয়ে শুরু হলেও এবার সামাজিক ব্যবসা হচ্ছে বাকি দুই ‘পিতে। ছোট-বড় সব সমস্যার সমাধান করতে হবে টেকসই পদ্ধতিতে- বলেন সামাজিক ব্যবসা ধারনার এ প্রবর্তক।ইউনূস আবারও চার মহাশক্তির কথা বলেন- তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন, সামাজিক ব্যবসা দিয়ে হবে টেকসই সমাজ। দারিদ্র, বেকারত্ব, কার্বন নিঃসরণকে শূন্যে নিয়েই অগ্রসর হতে হবে সে সমাজ পেতে। নতুন সভ্যতা লাভ হবে। নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে অর্থনীতি, রাজনীতিতে। নতুন ব্যবস্থা নিয়ে আমরা গৌরববোধ করতে পারবো।
ইউনূস বলেন, গ্রামীণের যারা গ্রাহক, ৮৫ লাখ ঋণগ্রহীতা কারও চাকরি করছে না। তারা নিজেরাই উদ্যোক্তা। প্রতিটি মানুষই বিরাট সম্ভাবনার। তাকে প্রচলিত চিন্তায় চাকরি পাওয়া না পাওয়ার গন্ডিতে আবদ্ধ রাখা বিরাট সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেওয়া।তিনি বলেন, নতুন সভ্যতা সৃষ্টি করতে হবে। পুরনো সভ্যতার দিন শেষ। নতুন সভ্যতায় আবর্জনা থাকবে না, বেকারত্ব থাকবে না। তরুণরাই সে সভ্যতা প্রবর্তন করবে।উপস্থিত তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, অবশ্যই পারতে হবে, উপায়তো নাই। পরিবেশ তাড়িত রিফিউজি হতে হবে। নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে যে, আমরা পারবো। তবেই পারবো।তিনি বলেন, এমন একটি সময় এসেছে যে, একটি বিকল্প রাখতে হবে। নাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। যেভাবে আমরা কাঠামোটি গড়ে তুলেছি, তাতে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সেভাবে চোখে পড়ে না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এ সমস্যাটি গভীরতর হচ্ছে।
ইউনূস বলেন, বর্তমান কাঠামোতে গলদ রয়ে গেছে। এখনই ঠিক না রাখলে সমস্যা অনেক বেড়ে যাবে। অর্থনৈতিক ধ্যান-ধারনা থেকে অচলাবস্থা তৈরী হয়েছে, পৃথিবী ঠিকই আছে। আমরা অচল করে রেখেছি তাকে।তিনি বলেন, আমরা যে ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরী করেছি, তাতে ধনীরা ক্রমশ সম্পদশালী হয়। কিন্তু যারা সম্পদশালী নন, তারা ক্রমশ নিচে নামেন।কিন্তু কোন মানুষের দোষে এটি নয়। শোষণযন্ত্রের দায়েই এমনটি হচ্ছে। তাই এ যন্ত্রই সংশোধন করতে হবে। নইলে সম্পদের ক্রমাগত পুঞ্জীভূত হওয়ার যে প্রক্রিয়া বিল্ট-ইন হয়ে আছে, তা থেকে বের হওয়া সম্ভব না। যে যতো মুনাফা করবে সে ততই সফল ও উজ্জীবিত, অন্যদিকে কেবলই অন্ধকার থাকবে। সম্পদের দিকে যারা নিচে, তারা ক্রমশই অসহায় হয়ে পড়ছেন’- বলেন তিনি।আবারও তিনি বলেন, ব্যবসায় শুধু ব্যক্তিগত মুনাফার দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, এক ‘পি ‘র (পারসন) সঙ্গে অন্য দুটি ‘পি’র (পিপল, প্ল্যানেট) দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যবসার মাধ্যমে গ্রহে সমস্যা তৈরী করছি। ব্যবসায় কল-কারখানা থেকে যে কার্বণ নিঃসরণ হচ্ছে, তাতে পৃথিবীর ক্ষতি হচ্ছে, উষ্ণতা বাড়ছে। এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে, দুই ডিগ্রি পর্যন্ত গেলে আর উপায় থাকবে না। এখনও একটু সময় আছে। তাই তাপের বৃদ্ধি থামিয়ে নিচে নামাতে হবে।তিনি বলেন, ফসিল ফুয়েল বিদায় দিতে হবে। মুনাফা যারা করছেন, তাদের অসুবিধা তারা চান না। পেট্রোল পৃথিবীর অনিষ্ট করছে। সৌরশক্তি ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীকে বাঁচাতে হবে।
পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে উপভোগ সীমা নির্ধারণ করতে হবে। সবটুকু শেষ করে যাওয়ার চিন্তা করলে চলবে না। এখানে কোন কিছুই অসীম নয়। আমরা যেটি বেশি ভোগ করবো, পরের প্রজন্মটি সেটি কম পাবে বা পাবে না। ইকোসিস্টেম ঠিক রেখে সম্পদের ব্যবহার করতে হবে’- যোগ করেন তিনি।ইউনূস বলেন, আমরা এখন সীমারেখা নিয়ে ব্যস্ত। আগে জনসংখ্যা কম ছিল। এখন অনেক। প্রায় ৭৩০ কোটি মানুষ পৃথিবীতে। প্রজন্মের ভেতরে একটি বিদ্বেষ রয়েছে, নিজেদের মধ্যেই কেউ বেশি ভোগ করছে, কেউ কম। এখানে বিদ্বেষ ও সংঘাত বাড়তে থাকবে।
গ্রামীণ ব্যাংকের পূর্ব ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ মানুষের জন্য কোন ব্যাংকিং ব্যবস্থা নেই। এর বাইরে রয়েছে মহাজন। সেটি বাদ দিয়ে আমরা ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তন করি। গরীবের জন্য ব্যাংকিং সিস্টেম নেই, তাদেরকে ব্যাংক সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছিল।এখন বলছি, শেষ দুটি পি নিয়ে ব্যবসা হয়। যেটিকে স্বার্থহীণতার ব্যবসা বলা যায়। ছোট ছোট সমস্যাগুলো টেকসই পদ্ধতিতে সমাধানের চেষ্টা করলাম আমরা। প্রথম পি নয়, পরের দুটি পি’র কারণে সামাজিক ব্যবসা মানুষের মনোযোগে এসেছে’- বলেন তিনি।
ইউনূস বলেন, বর্জ্যকে পূনরায় ব্যবহারের ব্যবস্থা যতদিন না করতে পারবো, পৃথিবীর সম্পদ কেবল কমতেই থাকবে। প্রতিদিন এটি কম মনে হবে, কিন্তু বছরে অনেকখানি অপচয়। সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে সম্পদের পূনরায় ব্যবহার করার চেষ্টা করছি।সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমাজসেবামূলক সংস্থা হেলথব্রিজের কান্ট্রি ডিরেক্টর দেবরা ইফরমসন।আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান ডা. এস. কাদির পাটোয়ারির সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন- উপাচার্য ড. একেএম মোহসীন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।
এছাড়া অংশ নেন কেবাংসান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহ আলম, জাপানের কিউসু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আশির আহমেদ, গ্রামীণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এইচ আই লতিফী, গ্রামীণ কমিউনিকেশন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজনিন সুলতানা।সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সোশ্যাল বিজনেস একাডেমিক সেলের সভাপতি ও ডিআইইউ’র ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী।