দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৮ মে: দারিদ্র্য, বেকারত্ব আর কার্বন নিঃসরণকে শূণ্যের কোঠায় নামানোই এখন বিশ্বের প্রধান চ্যালেঞ্জ— তবে বিদ্যমান ব্যবস্থা এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে অক্ষম বলে মনে করেন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই অক্ষমতা দূর করতে প্রয়োজন তারুণ্যের শক্তি, তথ্য-প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সামাজিক ব্যবসা ও সুশাসন বলেও জানান তিনি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ষষ্ঠ সামাজিক ব্যবসা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। সকাল ৯টার দিকে অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাংলাদেশের ঐতিহ্য তুলে ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে শিশুরা।এবার সামাজিক ব্যবসা দিবসের প্রতিপাদ্য ধরা হয়েছে আমরা চাকরি প্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা, যুব বেকারত্বকে উদ্যোক্তায় রূপান্তর (উই আর নট জব সিকারস, উই আর জব গিভারস- টার্নিং আনএমপ্লয়মেন্ট টু এন্টারপ্রেনারশীপ)।দিনব্যাপী সেমিনার ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে এতে থাকবে আলোচনা সভা। মোট ৩০ দেশের প্রায় ২৫০ জন প্রতিনিধি এ অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন বলে ইউনূস সেন্টার থেকে আগেই জানানো হয়েছে।এছাড়া থাকছে নবীন উদ্যোক্তাদের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মেলাও।
তরুণদেরকে মরিয়া হয়ে চাকরি না খুঁজে উদ্যোগী ও উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস। যে কোনো সামাজিক ব্যবসার পরিকল্পনা নিয়ে এলে তারা অংশীদার হবেন বলেও প্রতিশ্রতি দিয়েছেন এ অর্থনীতিবিদ।ড. ইউনূস বলেন, কেন তরুণরা চাকরির জন্য হা-পিত্যেশ করবে। তাদের মাঝে সে শক্তিই রয়েছে যে, অন্যের চাকরি না করে নিজেই আরেকজনকে চাকরি দেওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। আমাদের সঙ্গে যারা রয়েছেন, যারা আসবেন, তারা আমাদের ঋণগ্রহীতা নন, তারা আমাদের অংশীদার।তিনি বলেন, আমাদের শিশুদের জন্য ভবিষ্যতের জীবিকার নিশ্চয়তা তৈরি করতে হবে। কীভাবে কোন পথে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আসবে তা নিয়ে আমরা কথা বলছি। আমরা টেকসই সমাজের কথা বলছি।ইউনূস বলেন, আমরা আমাদের চিন্তাকে প্রয়োজনে নতুন করে সাজাবো। কেন কেউ কাজ না করে বসে থাকবে। বেকারত্ব শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এ সমস্যা ইউরোপেও রয়েছে। যেখানেই যে কাজ করতে চাইবে, তার জন্য সুযোগ রয়েছে’- বলেন তিনি।তিনি বলেন, আগ্রহ এখানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কেউ কারও সমস্যা সমাধান করে দেবে না, নিজে থেকেই এগিয়ে আসতে হবে, অন্যরা সহযোগিতা করবে।ইউনূস বলেন, ভালো চাকরি খোঁজার পরামর্শ দেওয়া ভুল, বরং উদ্যোক্তা হতে হবে।বক্তব্য পর্বে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সামাজিক ব্যবসাকেই সবচেয়ে অভিনব উপায় উল্লেখ করে একে সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে ছড়িয়ে দেয়ার আহবান জানান।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে সামাজিক ব্যবসাকে শিক্ষাক্রমে যুক্ত করার আহবান জানান বিশিষ্টজনেরা।এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন দেশ-বিদেশের সামাজিক ব্যবসার উদ্যোক্তারা।
সামাজিক ব্যবসা বা সোশাল বিজনেসের ধারণা উন্নয়নশীল দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নত অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কার্যকর উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, ২০০৮ সালে গ্রামীণ আমেরিকা তৈরি করার মধ্য দিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন কিছু সমাধান নেন যা বাংলাদেশের গ্রামগুলো থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতেও দারুণ ফল নিয়ে এসেছে।মার্শা বার্নিকাট বলেন, আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি সোশাল বিজনেস বাংলাদেশের এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে অগ্রগতিতে যে অবদান রেখেছে তা উদযাপন করতে এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পূরণ করতে সামনের বছরগুলোতে কীভাবে আরও বেশি করে অবদান রাখা যায় তা শিখতে। প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংককে প্রথম সোশ্যাল বিজনেস হিসেবে গণ্য করেন, যা ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে। সারা বিশ্বের বিশ কোটিরও বেশি মানুষ বিশেষ করে নারীরা মাইক্রোক্রেডিটের (ক্ষুদ্রঋণ) সুবিধা নিতে পারে। এই বিপ্লব ঘটানো পরিবারগুলো পুরো বাংলাদেশ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে বাস করে।তিনি বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং নাগরিকদের জীবন ব্যবস্থার মানদণ্ডের গড় সর্বোচ্চ হলেও দুঃখজনক হচ্ছে এখনও অনেক আমেরিকান দরিদ্র জীবন যাপন করে। এই দারিদ্র্য সামঞ্জস্যহীনভাবে নারীদের ওপর প্রভাব ফেলে। যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশের বেশি পরিবারের প্রধান নারী, কিন্তু তারা দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে। বাংলাদেশে যেমন, গ্রামীণ ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের এই কমিউনিটিগুলোর নারীদের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে দেখে, এর ফলে এই পরিবারগুলো দারিদ্র্য সীমার নিচ থেকে উঠে আসতে পারে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানান, গ্রামীণ আমেরিকা বর্তমানে ১২৫,০০০ ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে এবং ৪৭,০০০ বেশি নারীর কাছে পৌঁছেছে। এই কৌশল নারীদের নেটওয়ার্ক, অর্থনৈতিক প্রশিক্ষণ এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার মূলধন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের সুযোগ দেয়। গ্রামীণ আমেরিকা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি শহরে কাজ করছে এবং ছাব্বিশ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোগ ৫৭,০০০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যার মাধ্যমে এর প্রভাব পরিমাপ করা যায়।তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে, সোশাল বিজনেস বলতে বোঝায় নতুন উদ্যোগ গঠনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব এবং ব্যবসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখা। অলাভজনক উপদেষ্টা দ্য ব্রিজস্প্যান গ্র“পের মতে, গত দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায় শিক্ষা দেওয়া স্কুলগুলো তাদের বিদ্যমান পাঠক্রম ব্যবসায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামাজিক সুবিধার মত বিষয়গুলো বিবেচনা করে তা দ্রুত বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং নতুন কার্যক্রম শুরু করেছে, যা সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে নিবেদিতভাবে কাজ করে।উদ্যোক্তা এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের লক্ষ্যগুলোর অংশ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, দু’সপ্তাহ আগে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমাদেও স্পার্ক গ্লোবাল এন্টারপ্রিনারশিপ ইনিশিয়েটিভ’ নিয়ে কথা বলেছেন। এই প্রেগ্রামটির লক্ষ্য ২০১৭ সালের মধ্যে উঠতি উদ্যোক্তা এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের জন্য এক হাজার কোটি ডলার সংগ্রহ করা। আমাদের লক্ষ্য এই তহবিলের অর্ধেক অর্ধেক দিয়ে নারী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের সমর্থন দেওয়া। এসব অগ্রণী উদ্যোক্তাদের নতুন আবিষ্কার সারা পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভাবী মানুষদের জন্য সামাজিক সুবিধা নিয়ে আসবে। পৃথিবীর কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আপনারা যে অবদান রাখছেন তা প্রেসিডেন্ট আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন।এই প্রচেষ্টায় যোগ দিতে পেরে এবং সমর্থন জানাতে পেরে নিজের উচ্ছ্বাসের কথাও প্রকাশ করেন মার্শা বার্নিকাট।