দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৮ মে: ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেটের’ (আইএস) নেটওয়ার্ক বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির সমস্বয়ক আমিনুল ইসলাম বেগ ও তার সহযোগী সাকিব বিন কামাল কথিত জিহাদের নামে ইন্টারনেটে প্রচারণায় নামেন। নিজেদের মতাদর্শ প্রচারে গড়ে তুলেন ‘অনলাইন নেটওয়ার্ক’।ইরাক-সিরিয়ায় গণহত্যায় অভিযুক্ত জঙ্গি সংগঠন আইএসের সমর্থনে আধুনিক ও শিক্ষিত তরুণদের সংগঠিত করে সেখানে পাঠানোর লক্ষে তারা অনলাইনে নিজস্ব ব্লগ ও ফেসবুকের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলতো। এ পর্যন্ত তাদের নেটওয়ার্কে ৩০২ জন রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে ২০ জনের নাম-পরিচয়ও জানা গেছে।
আমিনুল ইসলাম বেগ ও সাকিব বিন কামাল নামের দুই আইএস অনুসারীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এমন অনেক তথ্যই বেরিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।গত রোববার রাতে রাজধানীর উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কের একটি বাসা থেকে আমিনুল ইসলাম (৫০) গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার সহযোগী সাকিব বিন কামালকে (৩৩) মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ, চার্জার, ডায়েরি ও তিনটি দামি মোবাইল সেটসহ কিছু জিহাদি বই উদ্ধার করা হয়। আদালতের নির্দেশে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আইএসের সঙ্গে বাংলাদেশি জঙ্গিগোষ্ঠির যোগাযোগের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন জঙ্গিদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট। দীর্ঘদিন ধরে উগ্র-কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিতে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটকেই বেশি ব্যবহার করছে তারা। গ্রেপ্তার জঙ্গিদের প্রত্যেকের ফেসবুক পেজে নানা বিষয়ে উসকানিমূলক অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। এসব তথ্যের সূত্র ধরেই চলছে তদন্ত।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মালেয়েশিয়া থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে লেখাপড়া শেষ করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোমল পানীয় কোম্পানীর আইটি বিভাগের চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমিনুল ইসলাম বেগের ধ্যান-জ্ঞ্যান ছিল আইএস। চাকুরির বাইরে যতটুক সময় পেতেন তিনি আইএস নিয়ে গবেষণা করতেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি আইএস সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য পেতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই সংগঠনটির ইরাক-সিরিয়া কেন্দ্রীক শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তিনি ফেসবুক পেজ খোলে আইএস সম্পর্কে সহকর্মীদের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করতেন। তিনি আইএস সম্পর্কে নিজস্ব গবেষণা ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে যা জানতে পারতেন তা ফেইসবুক ও নিজস্ব ব্লগে লিখতেন। অনলাইনে তার লেখা পড়ে বাংলাদেশের ফরিদপুরের গাজী সোহান, রাজশাহীর নাজিব উল্লাহসহ দেশের অন্যান্য জেলার সিফাদ, মাহমুল্লাহ, আতিকসহ ২০ জনের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। এভাবে তিনি অনলাইনে নিয়মিত যোগাযোগ বাড়াতে থাকেন। ইন্টারনেটে তার সঙ্গে যোগাযোগকারীদের মধ্যে কেউ প্রকোশলী, কেউ ডাক্তার, কেউ সরকারি কর্মকর্তা আবার কেউ কেউ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এরা সবাই সিরিয়া ও ইরাকে গণহত্যা চালানো আইএসের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুতি নেয় বলে গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন আমিনুল।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘তার ফেসবুক পেজে জঙ্গি লিংক ব্যাপক হারে পাওয়া যায়। সেখানে কয়েক হাজার লাইক পড়ে। এভাবে ক্রমান্বয়ে ওয়েব পেজের মাধ্যমে জঙ্গি প্রচার বাড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি।’সূত্র জানায়, আমিনুল নিজেও ইরাক-সিরিয়ায় যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই পথের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার মা মাহমুদা ইসলাম। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমিনুলের উগ্রপন্থা আর অতিমাত্রায় কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে তার মায়ের মনে সন্দেহ আর উদ্বেগের জন্ম নেয়। এ কারণে তিনি ছেলেকে এই পথ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বলেন। কিন্তু আমিনুল মায়ের কথা শোনেননি। ইন্টারনেটে আইএসের সঙ্গে যোগযোগ বাড়াতেই থাকেন। এক পর্যায়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকলে তার মা তাকে যেতে নিষেধ করেন। আমিনুল মায়ের অন্যান্য কথা না রখলেও এ আদেশ মেনে যুদ্ধে যাননি। এর কারণ হিসেবে আমিনুল গোয়েন্দাদের জানান-ইসলামের জন্য যুদ্ধে গেলে অবশ্যই মায়ের অনুমতি নিতে হয়। তাই মায়ের আদেশ না থাকায় তিনি সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধে যাননি।’তবে গত রোববার উত্তরা এলাকার বাসা থেকে গোয়েন্দারা যখন আমিনুলকে গ্রেপ্তার করতে যান তখন আমিনুল ও তার মা বাসায় ছিলেন। ডিবি কর্মকর্তারা পরিচয় দিয়ে ওই বাসায় ঢোকার পরই আমিনুলের মা জানালা দিয়ে দোতলা থেকে ছেলের ল্যাপটপটি নিচে ফেলে দেন। পরে রাস্তা থেকে আমিনুলের ল্যাপটপটি জব্দ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। আমিনুলকে গ্রেপ্তার করার সময় তার মা ছেলেকে বলেন ‘আমি আগেই বলেছিলাম, উগ্রপন্থায় বিশ্বাস এনো না, এ পথ ছেড়ে দাও। এখন বুঝলে মায়ের কথা না শুনলে কি হয়।’
আমিনুলের বাবার নাম শহিদুল ইসলাম বেগ।রিমাণ্ডের অপর আসামি সাকিব বিন কামল লালমাটিয়ায় শ্বশুরের বাড়ির নিচ তলায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন। ক্লাসে তিনি ছাত্রদের আইএসে উদ্ধুদ্ধ করতেন বলে অভিযোগ যাচাই বাছাই করছে গোয়েন্দারা। তার নির্দেশনাতেই স্কুলটি পরিচালিত হতো। তিনি নিজেও উচ্চ শিক্ষিত। আবার তার শ্বশর-শ্বাশুড়ি এবং মা বাবাসহ পরিবারের বেশিরভাগ লোকজনও উচ্চ শিক্ষিত। তিনিও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সিরিয়া-ইরাকে আইএসের গণহত্যা চালানো কথিত যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে যোগাযোগকারীরা হলেন, ঢাকার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সিরাজুল, ঢাকার একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সিরাজুল, কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের মেহেরুন্নেছা নামের এক শিক্ষক, শতাব্দি নামের এক চিকিৎসক। এছাড়া আরো রয়েছেন আব্দুল্লাহ, কামরান, মোজাদ্দিদ, ফয়সাল মোহাতার ও রায়হানসহ অনেকে।ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. শাহজাহান বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষিত আমিনুলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আইএসের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠে। তবে আমিনুল একটি গ্রুপের সমন্বয়কারী। তার আরো অনেক সমন্বয়কারী রয়েছেন। উগ্রপন্থায় বিশ্বাসি সংগঠনের সদস্যরাই আইএসের সহযোগী বলে গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তথ্য মিলেছে।
সূত্র জানায়, জঙ্গিদের ব্যবহার করা ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে কয়েকটি শনাক্ত করেছে গোয়েন্দারা। এগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো- ইসলামের আলো, বাঁশেরকেল্লা, সালাউদ্দিনের ঘোড়া (জসিম উদ্দিন রাহমানীর পেজ), দৃষ্টিভঙ্গি, যদি রাত পোহালে শোনা যেত শেখ হাসিনা মরে গেছে, দ্য মেসেজ অব ইসলাম, ইসলাম-ই-রাজনীতি, শিবির সংবাদ, জিহাদের ঝাণ্ডা আমরা চিরদিন উঁচু রাখব, বাগদাদ থেকে বাংলা, জিহাদ আর জিহাদ, আইএসআইএস (ইসলামিক স্টেট ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট), তিতুমীর-১, তিতুমীর-২, বাঁশেরকেল্লা (ফিনল্যান্ড, লন্ডন, ইউএসএ), বাঁশেরকেল্লা-নিউ, টিনের চালে কাক আমি তো অবাক। এ ধরনের অনেক ধর্মীয় উসকানিমূলক ওয়েব পেজে লাইক দিয়েছে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী।
জানা গেছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সঙ্গে প্রায় ১২ শতাংশ হলেও এটি ক্রমবর্ধমান। সাম্প্রতিক সময়ে সাইবার ক্রাইম অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণে পুলিশ সদর দপ্তরের উদ্যোগে গঠন করা হচ্ছে সাইবার ক্রাইম অ্যান্ড কম্পিউটার ফরেনসিক ইউনিট। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), র্যাব, সিআইডি থেকে পরিচালিত হবে বিশেষ ইউনিটের কার্যক্রম। ২০০৬ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অনুযায়ী সাইবার অপরাধীদের বিচার করা হয়।