দৈনিকবার্তা-ময়মনসিংহ, ২৬ মে: কৃষক বাবার একার আয় রোজগারের টাকা দিয়ে ৫ বোনসহ ৭ সদস্যের পরিবারের বরণপোষন চলে না। ৩ বেলা অভাব সংসার থেকে পিছুন ছাড়ে না। তারপরও আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বোনের খরচ। বড় দুই বোনের মত কাজের আশায় ঢাকায় যান গারো তরুণী অর্পিতা মান্দা (ছন্ম নাম)। যমুনা ফিউচার পার্কে ১ মাস ধরে পার্টাইম চাকরী করতো সে। থাকতো বড় বোনের বাসায় উত্তরায়।সংসারে চাকা ঘুরাতে ঢাকায় যাওয়া গারো তরুণীর সম্ভ্রম লুটেরাদের এখনো গ্রেফতার করতে না পারায় ক্ষোভ বিরাজ করছে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের পাহাড়ী জনপদ হাতিলেইট গ্রামে। ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে ১৫ কি মি দক্ষিণে হাতিলেইট গ্রামের অবস্থান। পহাড়ী লাল মাটি অধ্যুষিত হাতিলেইট গ্রামে বসবাস করেন ২ শতাধিক গারো পরিবার। তাদের একমাত্র পেশা কৃষি। গারোদের মধ্যে আধুনিকতা আসার পর তরুণীরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিউটি পার্লাসহ শপিংমলে পার্টটাইম হিসাবে চাকরী করে লেখাপড়া ও সংসার খরচের টাকা যোগান দেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন অর্পিতা মান্দা।
অপিতার পিতা কৃষি কাজ করে এক সময় জীবিকা নির্বাহ করতো। গত বছর তার বাবা ময়মনসিংহে নটরডেম কলেজ চতুর্থ শ্রেণীর পোস্টে চাকুরি পান। মা গৃনিী। অর্পিতার ৫ বোন। পিতার আয় রোজগারের টাকা দিয়ে চলতো ৭ জনের সংসার। বড় দুই বোন ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ঢাকায় যান। অর্পিতার তৃতীয় বোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য ২০১৩ সালে ঢাকায় যায় অর্পিতা মান্দা। ওই বছর এইচএসসি পাস করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স না পেয়ে ময়মনসিংহের আবুল মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হন। এর আগে ২০১১ সালে হাতিলেইট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৩ সালে ফুলবাড়িয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। উপজেলার হাতিলেইট গ্রামের অর্পিতার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা মানসিক ও শারীরিকভাবে পুরেপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন। তাকে সাত্ত্বনা দেয়ার জন্য গ্রামের লোকজনসহ তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন ভীড় করছেন। কারও সঙ্গে তিনি নিয়মিত কথা বলতে পারছেন না। অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তিনি।
বাড়িতে দেখাশুনা করেন তার মামা অজয়। তিনি জানান, এ্ই ঘটনার পর থেকে তার মা নিয়মিত খাবার দাবার ছেড়ে দিয়েছেন। এই ধরনের ঘটনা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এটা শুধু তার মা নয় অমাদের পুরো সম্প্রদায়কে ভাবিয়ে তুলিছে। গরো সম্প্রদায়রা জানান, এর আগে আমাদের সম্প্রদায়ের উপর এ ধরনের তিনটি ঘটনা ঘটেছে। কোনটির বিচার পায়নি। এবার আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এর ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাইতে চলতি সপ্তাহ ফুলবাড়িয়ায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষদের নিয়ে মানববন্ধন করবো। দোষীদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান তারা। তাদের অভিযোগ, আমাদের আত্মীয় স্বজন, সন্তানদের নিয়ে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। পেশা ও পড়াশুনার কাজে দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন অমাদের সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা। এই ঘটনা আমাদের আরও সর্তক করে দিয়েছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাবো।
মামা অজয় আরও জানায়, পাচঁ বোনের মধ্যে অর্পিতা মান্দা চার নাম্বার। বড় তিন বোনের মধ্যে সবার বড় বোন এইচএসসি পাশ করার পর ঢাকা একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেছেন। তার সঙ্গে ঢাকায় উত্তরায় বাসায় থাকতো সে। দ্বিতীয় বোন এইচএসসি পরীক্ষায় খারাপ ফল করে ঢাকায় তাদের সম্প্রদারের একটি মিশনারীতে কাজ করছেন। তৃতীয় বোন কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউম্যান রিচাস (এইচআর) তৃতীয় বর্ষের পড়ছেন। আর সবার ছোট বোনের বয়স ৯ বছর। সে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। তার মামা অজয় জানায়, গত মাস এপ্রিলের ২০ তারিখ সে ঢাকায় যায়। এর আগে সে পার্টটাইম জব করতো। যমুনা ফিউচার পার্কে যোগ দেয়ার আগে গ্রামের বাড়িতে ছিল আড়াই মাস। সর্বশেষ তার কর্মস্থলে যোগ দিতে এপ্রিলের ২০ তারিখ ঢাকায় যায়। এই প্রতিষ্ঠানে তার চাকুরি বয়স ১ মাস। তার মামা জানায়, ঘটনার দিন রাত ১২টার দিকে ফোনে এই ঘটনার কথা শুনতে পান। এর পর থেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তার মা। তার বাবা ঢাকায় গিয়েছেন মেয়েকে দেখতে।
অর্পিতার গৃহিনী মা কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মেয়ের সর্বনাশের কথা মুখ থেকে উচ্চারন করার আগেই ইশারায় বুঝান তিনি কথা বলতে পারছেনা। মেয়ের সর্বনাশের চিন্তা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বোনরা সবাই মেধাবী। নির্যাতিত মেয়েটি সবার সঙ্গে মিশতো। হাসিখুশি স্বভাবে এই মেয়েটি নিয়ে কোন অভিযোগ নেই তাদের।
এর আগে তিনটি ঘটনার ঘটেছে। একটিরও বিচার পায়নি। আমাদের নীরবতা সুযোগ নিয়ে এ ধরনের ঘটনার ঘটাচ্ছে দৃবর্রত্তরা।এবার এর প্রতিবাদ করবো। আমাদের পিট দেয়ালে টেকে গেছে। এরমধ্যে বুধবার ফুলবাড়িয়া উপজেলায় একটি মানববন্ধন করার উদ্যোগ নিয়েছে গাঢ়ো সম্প্রদার বলে জানান তাদের সম্প্রদায়ের একজন শিক্ষক। তিনি আরও জানান, আমাদের সন্তানরা পড়াশুনা, চাকুরি করতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। তাদের নিয়ে আমরা ভীষণভাবে চিন্তিত উদ্গিন্ন।
উপজেলা ট্রাইবার এসোসিয়েশনের সভাপতি লুইস জানান, বুধবার উপজেলা পরিষদের সামনে এঘটনার বিচার দাবী ও দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারের দাবীতে মানবন্ধন করা হবে। মানব বন্ধনের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক অংশ গ্রহন করবে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার বনানী বিশ্বাস জানান, তিনি বিষয়টি আদিবাসী নেতাদের কাছ থেকে শুনছেন। এ ব্যাপারে খোজ খবর নেয়ার কথা জানান তিনি।
এদিকে, রাজধানীতে মাইক্রোবাসে গারো সম্প্রদায়ের এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় থানায় মামলা নিতে বিলম্ব করাকে কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটের শুনানির পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেয়। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা তিন সপ্তাহের মধ্যে জানাতে স্বরাষ্ট্রসচিব,পুলিশের মহাপরিদর্শক,ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারকে নির্দেশদিয়েছেন হাইকোর্ট।একই সঙ্গে মামলা নিতে বিলম্ব ও অবহেলার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না এবং ধর্ষিতাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন নারীপক্ষ, মহিলা পরিষদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং ব্লাস্ট এ রিট পিটিশনটি দায়ের করে। আগামী ৩১ মের মধ্যে এই তালিকা আদালতে দাখিল করতে হবে। শুনানি শেষে আদালত রুল জারি করে নির্দেশনা দেয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন জেড আই খান পান্না, ব্যারিস্টার সারা হোসেন ও আইনুন নাহার সিদ্দীকা।অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল আমাতুল করিম।গত বৃহস্পতিবার ২১ মে রাতে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গারো সম্প্রদায়ের এক তরুণী কাজ শেষে উত্তরার বাসায় যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় ছিলেন। এ সময় পাঁচ ব্যক্তি তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে তারা ওই তরুণীকে উত্তরার জসিম উদ্দিন রোডে ফেলে রেখে যায়। এ ঘটনার পর শুক্রবার ধর্ষণের শিকার মেয়েটির স্বজনেরা ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। তরুণীর স্বাস্থ্য পরীক্ষায়ও ধর্ষনের আলামত পাওয়া গেছে।তরুণী যমুনা ফিউচার পার্কের একটি পোশাকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায়।
রুলে ধর্ষণের ঘটনায় এজাহার, সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো এবং পরীক্ষা করতে বিলম্ব কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, ধর্ষিতাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না এবং দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অবহেলার জন্য কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, উত্তরা, খিলক্ষেত, গুলশান, ভাটারা থানার ওসি এবং ভাটারা থানার ডিউটি অফিসারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।রুল ছাড়াও আদালত অন্তবর্তীকালীন আদেশ দেন। আদেশে বাংলাদেশের সব থানায় ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ ও জন্ম পরিচয় নির্বিশেষে বৈষ্যমহীনভাবে সবার সেবা নিশ্চিতে একটি সার্কুলার জারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি ও পুলিশ কমিশনারকে দিয়েছেন।এছাড়াও যৌন হয়রানি ও যৌন সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইন ও প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মীদের নিয়ে একটি কমিটি করতে আবেদনকারীদের কাছে নামের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট।এছাড়াও আদালত অন্তবর্তীকালীন আদেশও দিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন নারীপক্ষ, মহিলা পরিষদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং ব্লাস্ট-এর পক্ষ থেকে রোববার সংগঠনের করা এক রিট আবেদনের ওপর এই আদেশ দেওয়া হয়।আইনুন নাহার সিদ্দীকা জানান, বিষয়টি পরবর্তী আদেশের জন্য ১৪ জুন আবার কার্যতালিকায় থাকবে।