দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ মে: সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) অভিযোগ করে বলেছে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। এসময় নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করারও দাবি জানান সংগঠনটির নেতারা। সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘তিন সিটি নির্বাচনে আমরা কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজনের নেতারা এ অভিযোগ করেন।সিটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি দাবি করে সুজনের নেতারা বলেন, আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিকে পর্যবেক্ষন করি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ সংস্থার রিপোর্ট ও বিভিন্ন নির্বাচনী কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে ৩ সিটিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। এই নির্বাচন জনগণকে আশাহত করেছে।
সংগঠনটি তাদের জরিপে প্রকাশ করেছে, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৭৫.৫৫ শতাংশ (১৩৬ জন) ব্যবসায়ী। এ ক্ষেত্রে মেয়রদের হার শতভাগ। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার ৯০.২২ শতাংশ (১২০ জন) এবং সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলরদের মধ্যে ২৯.৫৪ শতাংশ (১৩ জন)। নারী কাউন্সিলরদের মধ্যে গৃহিণীই সবচেয়ে বেশি। যার হার ৩৪.০৯ শতাংশ (১৫ জন)। বিজয়ী ব্যবসায়ী প্রার্থী ঢাকা উত্তরে ৬৮.৭৫ শতাংশ, দক্ষিণে ৮০.২৬ শতাংশ এবং চট্টগ্রামে এর পরিমাণ ৭৫ শতাংশ।সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সহ-সম্পাদক জনাব জাকির হোসেন ও সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে প্রার্থীদের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, এই নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে প্রত্যাশা ছিল যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অর্থবহ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিরাজমান অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে একটি স্বস্তিময় পরিবেশে ফিরে আসতে আমরা সক্ষম হবো। বস্তুত সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা মানুষকে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তা আশাবাদী মানুষগুলোকে হতাশ করার পাশাপাশি জন্ম দিলো অনেক বিতর্কের।
সুজন অন্যান্য পর্যবেক্ষক সংস্থার মত নির্বাচনের দিন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে না। তাই নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি সুজনের পক্ষ থেকে। তবে আমরা জানি যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশসহ বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছে। প্রবন্ধে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“প, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, জাতিসংঘ, অধিকার, প্রথম আলো প্রভৃতি সংস্থার প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতকোত্তর। নবনির্বাচিত ৬৫.৭১% (২৩ জন) সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরই স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের ২৫% (৩জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে) হলেও ৩৩.৩৩% (৪জন) øাতক বা øাতকোত্তর। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতক। নবনির্বাচিত সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮.৬০% (২২ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)।
নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের অধিকাংশই (৫৫.৫৬% বা ১০ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতক। নবনির্বাচিত সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪.১৫% (১৪ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের ২৩.০৮% (৩ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে) হলেও ৩৫.৭১% (৫ জন) øাতক বা øাতকোত্তর।প্রার্থীদের পেশা সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৬৮.৭৫% ব্যবসায়ী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৮০.২৬% (৬১ জন) ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৭৫% (৪২ জন) ব্যবসায়ী। অর্থাৎ ৩টি সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৭৫.৫৫% (১৩৬%) ব্যবসায়ী। তিন জন মেয়রের সকলেই (১০০%) ব্যবসায়ী।”
প্রার্থীদের মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়র এবং সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই এবং অতীতেও ছিল না। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ১১ জনের বিরুদ্ধে ছিল। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা থাকলেও বর্তমানে নেই। সংরক্ষিত আসনের শুধুমাত্র একজন কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে ছিল।
চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে এবং অতীতেও ছিল। এর মধ্যে ৩০২ ধারার মামলাও অতীতে ছিল। সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে, ৩ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং ২ জনের বিরুদ্ধে বর্তমান ও অতীতে আছে ও ছিল। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ২১ জনের বিরুদ্ধে ছিল। ”
দিলীপ কুমার সরকার প্রার্থীদের আয় সম্পর্কে বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত ৪৮ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯ জন (৩৯.৫৮%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ৩ জন (৬.২৫%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ২ জন (৪.১৬%)। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত ৭৬ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ৩৭ জন (৪৮.৬৮%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ১ জন (১.৩১%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ৩ জন (৩.৯৪%)। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ৫৬ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ২৩ জন (৪১.০৭%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ২ জন (৩.৫৭%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ১ জন (১.৭৮%)।”
প্রার্থীদের সম্পদ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তরের ৪৮ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫৬.২৫% (২৭ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ১৬.৬৬% (৮ জন) কোটিপতি। ঢাকা উত্তরের ৭৬ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৬৪.৪৭% (৪৯ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ১০.৫২% (৮ জন) কোটিপতি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৫৬ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৭৩.২১% (৪১ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ৭.১৪% (৪ জন) কোটিপতি।প্রার্থীদের ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা উত্তরের ৪৮ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ১০.৪১% (৫ জন)। ঢাকা দক্ষিণের ৭৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ১৩.১৫% (১০ জন)। চট্টগ্রামের ৫৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ৮.৯২% (৫ জন)।
প্রার্থীদের কর প্রদান সম্পর্কে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত ৪৮ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৩৬ জন কর প্রদান করেন। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত ৭৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫০ জন কর প্রদান করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ৫৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫১ জন কর প্রদান করেন।
অর্থাৎ তিনটি সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ১৮০ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৭৬.১১% (১৩৭ জন) কর প্রদান করেন।প্রবন্ধে আরো বলা হয়, সুজন মনে করে, বিধ্বস্ত একটি নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে সঠিক পথে আনা, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা এবং নির্বাচনী আইনের সংস্কার ছিল জাতিগতভাবে আমাদের বড় অর্জন। নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, নিরপেক্ষতার অভাব এবং নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান প্রয়োগে নমনীয়তা এবং কোথাও কোথাও পক্ষপাতদুষ্টতা সেই অর্জনকে আমরা বিসর্জন দিতে বসেছি; যা আমাদের কাম্য ছিল না। এখনই যদি আমরা যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তবে আমাদের নির্বাচন পদ্ধতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।