দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ মে: ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকরে ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল চুক্তির অনুসমর্থনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে ‘দ্য প্রটোকল টু দ্য এগ্রিমেন্ট বিটুইন দ্য টু কান্ট্রিজ এ্যান্ড রিলেটেড ম্যাটারস’ শীর্ষক এ প্রোটোকল প্রস্তাবে অনুসমর্থন দেয়া হয়।বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারীদের নাগরিকত্ব নির্ধারণে নাগরিকদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়া হবে বৈঠকে শেষে এ কথা জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।
ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুসমর্থনের যে প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে, তাতে এ কথা বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের ছিটমহল যে দেশে অবস্থিত, বসবাসকারী নাগরিকেরা সেই দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রাথমিকভাবে ধরে নেয়া হচ্ছে, ছিটমহলটি যে দেশে অবস্থিত, বসবাসকারীরা সেই দেশেরই নাগরিক হতে চাইবেন। তবে, কেউ চাইলে তাদের পূর্ববর্তী দেশের নাগরিক হওয়ারও সুযোগ থাকবে।
সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় ১৯৭৪ সালের স্বাক্ষরিত ভারত-বাংলাদেশ স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়।ওই বছরের ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে চুক্তিটি অনুমোদন হলেও ভারতের লোকসভায় তা অনুমোদন হয়নি।২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এ সংক্রান্তপ্রটোকল সই হয়। ভারতের লোকসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন না হওয়ায় প্রটোকলটি এতদিন কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় চুক্তিটি অনুমোদন হওয়ায় সোমবার বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় প্রটোকলটি অনুমোদন হয়েছে।
ছিটমহলে বসবাসরতদের নাগরিকত্বের ব্যাপারে নাগরিক অভিপ্রায় প্রাধান্য পাবে—এ কথা জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে মোট জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১৬০. ৬৩ একর। জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৮৬ জন।এদিকে, ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন সাত হাজার ১১০. ২ একর।জনসংখ্যা ১৪ হাজার ৯০ জন। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ছিটমহলের ১০ হাজার ৫০ দশমিক ৬১ একর জমি বেশি পাবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বেশির ভাগ জায়গা চিহ্নিত থাকলেও ৬. ৫ কিলোমিটার এলাকা চিহ্নিত করা ছিল না। পঞ্চগড়,মৌলভীবাজার ও ফেনীর কিছু এলাকায় এই সীমানা এতদিন চিহ্নিত ছিল না। এ ছাড়া তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে বলেও জানান সচিব।দুই দেশের অবৈধ দখলে থাকা জমি প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ভারতের দখলে ছিল বাংলাদেশের ২ হাজার ২৬৭. ৮৮ একর জমি। আর ভারতের জমি বাংলাদেশের দখলে ছিল ২ হাজার ৭৭৭.১৪ একর জমি। অর্থাৎ ৫০৯ .২৬ একর বেশি জমি বাংলাদেশের দখলে ছিল। দুই দেশের অনুমোদন চূড়ান্ত হয়েছে, এখন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় এ বিষয়টির অগ্রগতি হবে ।
এছাড়া বৈঠকে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ সর্বাধিনায়কতা আইন ২০১৫ এবং প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ সংশোধন আইন ২০১৫-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, দু’দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় ও অমীমাংসিত সীমানা নির্ধারণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী এ স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ঐতিহাসিক এ মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে অনুসমর্থন দেয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর এ ব্যাপারে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।চুক্তিটি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনেরও প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সংবিধান সংশোধন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এ জন্য পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়। সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে স্থল সীমান্ত চুক্তিতে অনুসমর্থন দেয়া হয়।চুক্তিটি বাস্তবায়নে ২০১১ সালে ঢাকায় দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের উপস্থিতিতে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
ওই সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় এ প্রটোকলে স্বাক্ষর করেন।ভূইঞা বলেন, ভারত সরকার কর্তৃক স্থল সীমান্ত চুক্তির অনুমোদন না হওয়ায় প্রটোকল কার্যকরের কোন সুযোগ ছিল না। এজন্য এতদিন প্রোটোকল উত্থাপিত হয়নি।
ভুইঞা বলেন, ভারতের লোকসভা সম্প্রতি এলবিএ অনুমেদান করেছে। দুই সরকারকে এই প্রটোকল অনুমোদন করতে হবে। এখন যথাযথ সময়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ মন্ত্রিসভায় প্রটোকলটি উপস্থাপন করে এবং মন্ত্রিসভা এটি অনুমোদন দিয়েছে। প্রটোকলটি অনুমোদন করায় এখন এটি বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তিনি বলেন,প্রটোকল অনুযায়ী বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত ছিটমহলগুলো বাংলাদেশ পাবে এবং ভারতের ভূখন্ডের মধ্যে অবস্থিত ছিটমহলগুলো ভারত পাবে।বাংলাদেশের ছিটমহলে বসবাসকারী কোন ভারতীয় নাগরিক ইচ্ছা করলে সেখানেই থাকতে পারবে। তবে তাকে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নিতে হবে।
আবার ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারী কোন বাংলাদেশী সেখানেই থাকতে চাইলে তাকে ভারতের নাগরিকত্ব নিতে হবে।
তিনি বলেন, ছিটমহলে বসবাসকারীদের ইচ্ছকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে।মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, বাংলাদেশ ১০ হাজার ৫০ দশমিক ৬১ একর জমি বেশি পাবে ভারতের কাছ থেকে। বাংলাদেশ মোট ১১১টি ছিটমহল পাবে। এই ছিটমহলগুলোতে মোট জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ১শ’ ৬০ দশমিক ৬৩ একর। ভারত পাবে ৫১টি ছিটমহল। এই ছিটমহলগুলোতে জমির পরিমাণ ৭ হাজার ১শ’ ১০ একর। ১শ’ ১১টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ৩৭ হাজার ৩শ’ ৮৬ জন। অপর দিকে ৫১টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ১৪ হাজার ৯০ জন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব দুই দেশের দখলে থাকা অমীমাংসিত জমি সম্পর্কে বলেন, ভারতের দখলে ছিল বাংলাদেশের ২ হাজার ২শ’ ৬৭ দশমিক ৮৮ একর জমি। আর বাংলাদেশের দখলে ছিল ভারতের ২ হাজার ৭শ’ ৭৭ দশমিক ১৪ একর জমি। চুক্তি অনুমোদনের পর এই জমি বিনিময় করতে হবে।ভুইঞা আরো বলেন, প্রটোকলের অধীনে আঙ্গরপোতা-দহগ্রামে বসবাসকারীরা ভারতের তিনবিঘা করিডোর দিয়ে এখন সবসময় চলাচল করতে পারবে। এখন প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা খোলা থাকবে।মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরো বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বেশির ভাগ জায়গা চিহ্নিত থাকলেও ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলাকা চিহ্নিত করা ছিল না। প্রটোকল অনুমোদনের পর এই বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতকে এখন এই মূল চুক্তি ও প্রটোকলে চূড়ান্ত স্বাক্ষর করতে হবে।ভুইঞা বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফরকালে এলবিএ ও প্রটোকল বিনিময় হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
বৈঠকে আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং সাপেক্ষে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ (সর্বাধিনায়কতা) আইন-২০১৫ এবং প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ (সংশোধন) আইন ২০১৫-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়।১৯৭৮ সালে ইংরেজি ভাষায় সামরিক অধ্যাদেশ হিসেবে এ দু’টি আইন জারি হয়। এজন্য মন্ত্রিসভার পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত মোতাবেক আইন দু’টি বাংলা ভাষায় রূপান্তরের জন্য সংশোধনীর প্রয়োজন হয়।বৈঠকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এম শাহরিয়ার আলমের ৪ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ওমান সফর সম্পর্কে অবহিত করা হয়।মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীবৃন্দ ও সচিবগণ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।