দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৫ মে: জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার, যে সংগঠনটির সঙ্গে আল কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। সোমবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন হয়েছে।স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, সংগঠনটি নিষিদ্ধ হয়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তৎপরতার খবর প্রায় তিন বছর আগে গোয়েন্দা তথ্যে উঠে আসে।এই দলটির আমির মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়ে বর্তমানে বিচারের মুখোমুখি। রাজীবের পর অন্য ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের পেছনেও আনসারুল্লাহর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, তাদের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠায় এবং পুলিশের পক্ষ থেকে সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব আসায় আমরা গত বৃহস্পতিবার রাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হলো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নিষিদ্ধ করার বিষয়টি মানুষকে জানানোর জন্য এরই মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। গেজেট আকারে মুদ্রণের জন্য বিষয়টি বিজি প্রেসেও পাঠানো হয়েছে।সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী এ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে ২০০৫ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ ( জেএমজেবি), জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি বি) ও শাহাদাত আল হিকমাতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের চেয়েও বড় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তারা আল-কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ ধারা অনুযায়ী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানানো হয়। এরপর মন্ত্রণালয় সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
সংগঠনটি লেখক, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের হত্যা করছে, হুমকি দিচ্ছে বলে পুলিশ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এ ছাড়া গত বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ চার শিক্ষক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে তাঁদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার পর সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত তরান্বিত হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম একটি সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন। সংগঠনটি ২০১৩ সাল থেকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। বাংলাদেশের যুবকদের উগ্রপন্থী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করে জিহাদের মাধ্যমে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। সংগঠনটি তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য মসজিদকেও ব্যবহার করে থাকে। সংগঠনটির হামলার মূল লক্ষ্য হলো মুক্ত চিন্তার অনুসারী, ব্লগার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা জেলার একটি মসজিদে জঙ্গি হামলা ও নাশকতার পরিকল্পনা করার সময় সংগঠনটির নেতা মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ ৩০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি তারা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যা করে। এ হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, যাঁরা পরে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে এবং ৭ মার্চ সানিউর রহমানকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালানো হয়। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রীর ওপর হামলা চালান। এতে অভিজিৎ রায় নিহত ও তাঁর স্ত্রী গুরুতর জখম হন। গত ৩০ মার্চ ব্লগার ওয়াসিকুর রহমানকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামটি ইরাকি আল-কায়েদার আনসার উল ইসলাম-এর অনুকরণে নেওয়া। তবে বাংলাদেশি এই গোষ্ঠী আধ্যাত্মিক নেতা মানেন ইয়েমেনভিত্তিক আল-কায়েদার নেতা আনওয়ার আওলাকিকে। আল-কায়েদা ইন অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা (আরব উপদ্বীপ) নামে সক্রিয় এই গোষ্ঠীর প্রধান আওলাকি ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ড্রোন (চালকবিহীন বিমান) হামলায় ইয়েমেনে নিহত হন।দেশের নামকরা একাধিক সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক এই গোষ্ঠীর যাত্রা ২০০৮ সালে। তখন রাজধানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাবেক ক্যাম্পাসের কাছাকাছি বনানীর একটি মসজিদকে ঘিরে আল-কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী এ গোষ্ঠীর কার্যক্রম শুরু হয়। প্রধানত ইংরেজি মাধ্যম বা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে তাদের মতাদর্শ প্রচার ও উদ্বুদ্ধকরণ চলত। পরে ফেসবুক, ব্লগসহ তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক কার্যক্রম শুরু করা হয়।