দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৩ মে: ঢাকা-আরিচা-খুলনা রুটে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস ধর্মঘট অব্যাহত থাকায় যাত্রীরা বিপাকে পড়েছেন৷ ট্রেন বা অন্য রুটের গাড়ি ধরে কেউ কেউ গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেও অনেককে যাত্রা বাতিল করতে হচ্ছে৷১৯ মে সকালে ফরিদপুরের মধুখালীতে ঢাকাথেকে বেনাপোলগামী সোহাগ পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে৷ ওই বাসের ২২ জন যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই বাসের চালক ও সহকারীকে আটক করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ডাকাতির মামলা হয়৷ এরপর গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তিসহ তিন দফা দাবিতে ২০ মে থেকে খুলনা অঞ্চলের পরিবহন মালিক ও শ্রমিকেরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকেন৷ আটক চালক, হেলপার ও চেকারকে নিঃশ্বর্ত মুক্তি না দিলে সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধের হুমকি দেয়া হয়েছে৷শনিবার দুপুরে যশোরে সংবাদ সম্মেলন করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ এ হুঁশিয়ারি দেন৷ এসময় ফরিদপুরের পুলিশ সুপার ও মধুখালী থানার ওসির বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করা হয়৷
সংগঠনের আহ্বায়ক আলী আকবর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৮ মে রাতে ঢাকা থেকে সোহাগ পরিবহনের একটি বাস বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়৷ পথিমধ্যে ফরিদপুরের মধুখালিতে ডাকাতের কবলে পড়ে৷ ডাকাতি করে ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর চালক আয়নাল হোসেন বাসটি নিয়ে থানায় হাজির হন৷ এসময় তিনি ডাকাতির বিষয়টি উল্লেখ করে মামলার নেয়ার অনুরোধ করেন৷ কিন্তু মুধখালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ১৯ মে ফরিদপুরের এসপির নির্দেশে চালককে সকাল পর্যন্ত বসিয়ে রাখেন৷এরপর চালক আয়নাল, হেলপার অপু ও চেকার রবিউলকে আসামি করে ডাকাতির মামলা করে তাকে আটক করা হয়৷ এ ঘটনার প্রতিবাদে খুলনা ও বরিশাল রুটে পরিবহনের ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু তারপরও চালক, হেলাপার ও চেকারকে মুক্তি না দেয়ায় ২২ মে থেকে পরিবহনের পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৮ রুটে ভাড়ায় চালিত সব ধরনের যানবাহান বন্ধ করে দেয়া হয়৷ কিন্তু ২৩ মে পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন৷ এ দাবি আদায় না হলে তারা মালিক শ্রমিক মিলে সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট ও বাস ধর্মঘট আহ্বান জানাবেন৷সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক সমিতির সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু বলেন, এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে তারা ইতোমধ্যে রাজশাহী অঞ্চলের ও রাজবাড়ী জেলার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন৷ সেখানকার নেতারা আন্দোলনের ব্যাপারে সম্মত আছেন৷সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা সাদেক আহম্মদ বলেন, নেতৃবৃন্দ ফরিদপুর পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু এসপি তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যাবহার করেন৷ এজন্য এসপি ও ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি করছি৷সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- পরিবহন মালিক সমিতির নেতা পবিত্র কাপুড়িয়া, আবুল কাশেম, রমেন মণ্ডল, যশোর জেলা ট্যাংক লরি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ইন্তাজ আলী, সীমান্ত বাস মালিক সমিতির সভাপতি জুল হোসেন প্রমুখ৷
খুলনার সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে শনিবার কথা হলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরিফুল রহমানের সঙ্গে৷ তিনি জানান, অফিসের জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হবে৷ খুলনা-আরিচা রুটের বাস বন্ধ থাকায় অন্য রুটের বাস ধরার চেষ্টা করছেন তিনি৷ দুই হাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে যশোর যেতে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে বাসের অপেক্ষা করছিলেন রমিছা খাতুন (৭০)৷ তিনি বলেন, তাঁর মেয়ে যশোরে থাকে৷ মেয়ে অসুস্থ্তখবর পেয়ে মংলা থেকে খুলনা এসেছেন৷ ওই পথে গাড়ি না চলায় কীভাবে মেয়ের বাড়ি যাবেন, তিনি সেই চিন্তা করছেন৷যশোর রুটে দূরপাল্লার সব বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীরা নসিমন, ইজিবাইক ও টেম্পোতে করে যশোর যাচ্ছেন৷ খুলনা নগরের রয়েলের মোড়ে দেখা যায়, সেখানকার খুলনা-আরিচা-ঢাকা রুটের চলাচলকারী বাসের কাউন্টারগুলো খোলা৷ কিন্তু টিকিট বিক্রি না করায় অনেক যাত্রী টিকিট কিনতে এসে ফিরে গেছেন৷ এমনই একজন গৃহিণী মিতুয়া রহমান৷ তিনি জানান, অসুস্থ বোনকে দেখতে ঢাকার সাভারের আমিনবাজার যেতে হবে তাঁকে৷ আরিচা হয়ে কোনো বাস না চলায় তিনি রাতের ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ ছেলে-মেয়ের বিদ্যালয় ছুটি, তাই সপরিবারে ঢাকায় বেড়াতে যাওয়ার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের টিকিট কেটেছিলেন তন্ময় রায়৷ কাউন্টার থেকে টিকিট ফেরত দেওয়ায় ঢাকায় না গিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন বলে তিনি জানালেন৷
এ ব্যাপারে খুলনা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিন দফা দাবিতে আঞ্চলিক কমিটি ধর্মঘট ডেকেছে৷ আমরাও এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ধর্মঘট পালন করছি৷ গ্রেপ্তারকৃতদের ছাড়াতে আইনি সহায়তা না নিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছেন কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাসে ডাকাতির ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে শ্রমিকদেরই জেলে পাঠিয়েছে৷ আমরা আইনের সহায়তা নেওয়ার জন্যই থানায় গিয়েছিলাম৷ কিন্তু তাঁরা আমাদের সহায়তা করেননি৷ এ কারণে ধর্মঘট করা হচ্ছে৷ আটক শ্রমিকদের মুক্তি, ওই সময় কর্তব্যরত পুলিশ ও ফরিদপুর পুলিশ সুপারের অপসারণ না করা পর্যন্ত এ ধর্মঘট চলবে৷শুক্রবার বিকেলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার জামিল হাসান এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ১৯ মে ভোরে ডাকাতি সংঘটিত হওয়া বাসের ২২ জন যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই বাসের চালক ও সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
পুলিশ সুপার বলেন, যাত্রীবেশী সাত ডাকাত আশুলিয়া থেকে বাসে ওঠে৷ ফরিদপুর শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড় এলাকা পার হওয়ার পরপরই ওই ডাকাতেরা বিনা বাধায় চালকের কাছ থেকে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতি করে৷ ডাকাতির পর যাত্রীদের দাবির মুখে বাধ্য হয়ে চালক বাসটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মধুখালী রেলগেট এলাকায় থামালে যাত্রীরাই মধুখালী থানায় ফোন করে ঘটনাটি জানান৷ পুলিশ সুপার বলেন, মালিক সমিতির নেতারা আমার কাছে বাসচালক ও হেলপারের জামিনের ব্যাপারে সহযোগিতা েেচয়েছেন৷ কিন্তু আমার পক্ষে কোনোভাবেই সহযোগিতা করা সম্ভব নয়৷ জামিন দেওয়ার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার৷ তিনি বলেন, মালিক ও শ্রমিকেরা জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেন এবং তাঁদের জিম্মি করে ধর্মঘট করে বাস ডাকাতির মামলার আসামিদের জামিনের সুযোগ নিতে চান৷ কিন্তু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে৷
খুলনা বিভাগের ছয় জেলা ও ফরিদপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলে চলমান অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের চতুর্থ দিন শনিবার দুপুরে যশোর বাস মালিক সমিতির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ হুমকি দেওয়া হয়৷সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে আটক শ্রমিকদের মুক্তি ও দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে সারা বাংলাদেশে পরিবহন ধর্মঘট শুরু করা হবে৷সম্মেলনে খুলনা বিভাগীয় মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আলী আকবার লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান৷
পরিবহন ধর্মঘটকে শ্রমিকদের যৌক্তিক আন্দোলন দাবি করে মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নেতা আলী আকবার বলেন, এ আন্দোলন থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই৷ রাজশাহী, বরিশাল ও ঢাকাসহ সব বিভাগের মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা চলছে৷ফরিদপুরের মধুখালীতে বেনাপোলগামী সোহাগ পরিবহনের একটি নৈশকোচে সোমবার রাতে ডাকাতির পর যাত্রীদের অভিযোগে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাসটির চালক ও তার এক সহকারীকে আটক করে৷পরে ডাকাতির মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷তবে ডাকাতির পর চালক বাস নিয়ে মধুখালী থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ তাদের আটক করে কারাগারে পাঠায় বলে দাবি করেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা৷এরপর আটক দুই পরিবহন শ্রমিকের নিঃশর্ত মুক্তি এবং ফরিদপুরের পুলিশ সুপার ও মধুখালীর ওসিকে প্রত্যাহারের দাবিতে খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, নড়াইল ও ফরিদপুর থেকে ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ১৮টি রুটে বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের ডাক আসে৷
তবে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার জামিল হাসান শুক্রবার সন্ধ্যায় তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বাসযাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই বাস চালক ও তার সহকারীকে আটক করা হলেও তাদের ছাড়িয়ে নিতে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করছেন৷তার এ অভিযোগের পর ধর্মঘটের চতুর্থ দিন শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকেও ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ড গিয়ে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি৷যশোর যেতে আকাশ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ীসহ আরও কয়েকজনকে দুই ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় বাসের জন্য৷আকাশ বলেন, ব্যবসার জন্য যশোর যেতে হবে, এভাবে ধর্মঘট চলতে থাকলে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়তে হবে৷যানবাহন না চলায় যাত্রীদের দুর্ভোগের পাশাপাশি বেকায়দায় পড়েছেন পরিবহন শ্রমিকরাও৷বাসস্ট্যান্ডের সুবর্ণ পরিবহনের কাউন্টার গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন শ্রমিক বসে আছেন৷ ধর্মঘটের কারণে চারদিন ধরে কাজ বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানান এসব শ্রমিক৷হাবিব মোল্লা নামে এক পরিবহন শ্রমিক বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই৷ এভাবে চলতে থাকলে শুধু যাত্রীরাই সমস্যায় পড়বে না, শ্রমিকরাও সমস্যায় থাকবে৷”এর মধ্যে শনিবার ঝিনাইদহের শৈলকুপা থেকে কুষ্টিয়া ও যমুনা সেতু হয়ে ঢাকাগামী বেশকিছু বাস ছেড়ে দেখা গেছে বলে শ্যামলী পরিবহনের টিকেট কাউন্টার থেকে হিল্লোল হোসেন জানিয়েছেন৷এছাড়া ঝিনাইদহের অন্য কোনো স্থান থেকে কোন ধরনের দূরপাল্লার যানবাহন ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি৷ঝিনাইদহ বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি উজ্জল বিশ্বাস বলেন, খুলনা বিভাগীয় নেতারা বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন, তারা তার সমর্থন দিয়েছেন৷দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট মেনে চলবেন জানালেও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ের দ্রুত সমাধান আশা করছেন যাত্রী ও শ্রমিকদের অধিকাংশই৷