দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ২০ মে: রাজশাহী নগরে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য একসময় প্রসিদ্ধ ছিল ঢোপকল৷ ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে বসানো এসব ঢোপকলের অনেকগুলোই এখনো সচল৷ নগরের সড়ক সমপ্রসারণের নামে একের পর এক ঢোপকল উচ্ছেদ চলছেই৷২০১০ সালের দিকে নগরে প্রায় ২০টি ঢোপকল ছিল৷ রাসত্মা প্রশসত্মকরণ ও বর্তমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় রাজশাহী সিটি করপোরেশন এসব ঢোপকলের বেশির ভাগই ভেঙে ফেলেছে৷
সর্বশেষ ১৩ মে নগরের চন্ডীপুর এলাকায় একটি ঢোপকল অপসারণ করা হয়৷ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাসত্মা চওড়া করার জন্য এটি অপসারণ করতে হয়েছে৷সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, রায় ডি এন দাশ গুপ্ত (১৯৩৪-৩৯) রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকাকালে তাঁর উদ্যোগ এবং রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় নগরবাসীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধানত্ম নেন৷ সে সময় রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন মহারাণী হেমনত্ম কুমারীসহ অন্যান্য দানশীল ব্যক্তিকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার অনুরোধ করে৷ তখন হেমনত্ম কুমারী একাই ৬৫ হাজার টাকা অনুদান দেন৷ বিশাল অঙ্কের একক অনুদানের কারণে রাজশাহী জেলা বোর্ডের দান করা জমিতে মহারাণী হেমনত্ম কুমারীর নামেই ‘ওয়াটার ওয়ার্কস’ স্থাপিত হয়৷ সেই সময় ঢোপকলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থার পাইপগুলো ছিল কাস্ট আয়রনের এবং অন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো ছিল পিতলের তৈরি৷ সিমেন্টের তৈরি ঢোপকলগুলো ব্যতীত অন্য সবকিছুই ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল৷ সে সময় হেমনত্ম কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসে প্রতিদিন ভূ-গর্ভস্থ পানি শোধন করা হতো৷
এই পানি শোধন কেন্দ্রে আয়রন, ম্যাংগানিজ ও পানির ক্ষারতা দূর করার ব্যবস্থা ছিল৷ এই শোধিত পানি রাজশাহী নগরের মোড় মোড়ে স্থাপিত ১০০টিরও বেশি ঢোপকলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ ঢোপকলের প্রতিটির পানি ধারণক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন৷ এগুলোর প্রতিটিই ছিল একটি ‘রাফিং ফিল্টার’৷ এতে বালি ও পাথরের সত্মর ছিল যাতে সরবরাহকৃত পানি আরও পরিশোধিত হয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাত৷ সে সময় সারা দিনে মাত্র দুই ঘন্টা পানি সরবরাহ করা হতো৷ এ জন্য প্রতিটি ঢোপকলকে পানি রিজার্ভ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো৷বর্তমানে সড়ক প্রশসত্মকরণের নামে এসব ঢোপকল সরিয়ে ফেলা হচ্ছে৷ শুধু সিটি করপোরেশন নয়, অন্য লোকজনও নিজের সুবিধার জন্য ঢোপকল সরিয়ে ফেলছেন৷ এ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে৷
রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির বলেন, রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এই ঢোপকল দেশে আর কোথাও নেই৷ তত্কালীন সময়ে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহের যে দৃষ্টানত্ম তা বিরাট ঐতিহ্য৷ নির্বিচারে এই ঢোপকলগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে৷ তিনি এগুলো সংরক্ষণের জোর দাবি জানান৷হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ঢোপকলগুলো রাজশাহীর ঐতিহ্য৷ ঢোপকলের মতোই রাজশাহীর অনেক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে৷ এই ঐতিহ্যগুলো রক্ষার জন্য অতিসত্বর রাজশাহীতে একটি নগর জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা উচিত৷ এ ছাড়াও রাজশাহীতে যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন এখনো টিকে আছে সেগুলো রক্ষার জন্য সবাইকে উদ্যোগী ও সচেতন হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, ‘রাসত্মা সমপ্রসারণের জন্য ঢোপকলগুলো ভাঙা হয়েছে৷ সবগুলো ঢোপকল আর চালু নেই৷ রাসত্মা বড় করতে গেলে এগুলো আর রাখা যাচ্ছে না৷ তা ছাড়াও বর্তমান পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে এগুলো যায় না৷’তিনি জানান, যেসব ঢোপকল অপসারণ করা হচ্ছে তা ঐতিহ্য হিসেবে ফুটপাতে এমনি বসিয়ে রাখা হবে৷ যাতে ভবিষ্যতে মানুষ বুঝতে পারে যে এগুলো দিয়ে একসময় নগরে পানি সরবরাহ করা হয়েছে৷