দৈনিকবার্তা-রাজশাহী, ১৯ মে: গত বুধবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বড়গাছী গ্রামের নবাব আলী। পায়ে জখমপ্রাপ্ত হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে আসেন চিকিৎসা নিতে। এরপর একজন চিকিৎসক তাঁকে দেখে জখমপ্রাপ্ত হাঁটুর এক্স-রে করাতে হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে পাঠান। গত বুধবার সকাল ১১টার দিকে এক্সরে করান নবাব। এরপর ওইদিন বিকেলে তার এক্সরে রিপোর্ট দেওয়া হয়। কিন্তু তার আগেই বর্হিবিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। নবাব পরেরদিন বৃহস্পতিবারে সকালে পুনরায় বর্হিবিভাগের অর্খপেডিক্স বিভাগের ওই চিকিৎসকের কাছে যান। এসময় ওই চিকিৎসক রিপোর্ট দেখতে গিয়ে দেখেন, হাঁটুর যেখানকার এক্স-রে করানোর কথা বলা হয়েছে, সেখানে না করে অন্য আরকে জায়গার এক্স-রে করে তার রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়টি দেখে ওই চিকিৎসক আবার নবাবকে পুনরায় এক্স-রে করার জন্য রেডিওলজি বিভাগের পাঠান। হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় এক্স-রে করান তিনি।
তবে সেইদিনও বিকেলে রিপোর্ট দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর মাঝে শুক্রবার হাসপাতোলের বর্হিবিভাগ বন্ধ থাকায় শনিবার ফের ওই চিকিৎসকের কাছে রিপোর্ট দেখাতে যান নবাব। তবে সেদিনও ওই চিকিৎসক তাঁকে জানান, ভুল এক্স-রে করানো হয়েছে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নবাব ছুটে আসেন হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগে। এক্স-রে বিভাগে দায়িত্বরতদের সঙ্গে এ নিয়ে বাক-বিতন্ডতাওে জড়িয়ে পড়েন তিনি। জানতে চান, কেন বার বার এভাবে ভুল রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। আর তাকে দিনের পর দিন হয়রানি করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এক্স-রে বিভাগ থেকে জানানো হয়, শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীরা এক্স-রে করেছে বলে দুই-দুইবার ভুল হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নবাব আলী রেডিওলজি বিভাগের দায়িত্বরতদের সঙ্গে পেরে না উঠে অনেকটা ক্ষোভ ও অভিমান নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েই চলে যান। জানা গেছে, শুধু নবাবই নন, হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের ভুল রিপোর্টের কারণে তাঁরমতো প্রতিদিনে একইভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে রোগী ও স্বজনদের। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে ওই বিভাগের দায়িত্বরতদের পাশাপাশি দালালদের দারাও নিগৃহীত হচ্ছের রোগী এবং স্বজনরা। এ নিয়ে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে হাসপাতালের চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মাঝে। অন্যদিকে একই বিভাগের আওতায় সিটিস্ক্যান মেশিনটিও অকেজো হয়ে আছে বেশকিছুদিন ধরে। ফলে বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করাতে গিয়েও অতিরিক্ত অর্থ গুণতে হচ্ছে রোগীদের। আবার অর্থভাবে সিটি স্ক্যান করাতেও পারেছন না অনেকেই।
হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার সময় রোগী নবাব আলী অভিযোগ করে জানান, ১৭০ টাকার এক্স-রে রিপোর্ট করাতে তাঁর নিকট থেকে ২৫০ টাকা আদায় করা হয়েছিল। কথা ছিল রিপোর্ট তাড়াতাড়ি দেওয়া হবে। কিন্তু সেটিও করা হয়নি। উপরন্ত ভুল রিপোর্ট দিয়ে তাঁকে তিনদিন ধরে ঘুরানো হয়েছে। সূত্র জানায়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগটি পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীদের দ্বারাই। আর এখানে কর্মরত ১২ জন টেকনিশিয়ান সময় দেন না ঠিকমতো। ফলে অদক্ষ শিক্ষানবিশদের কারণে বারবার ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে রোগীদের।
রেডিওলজি বিভাগে এক্স-রে করানোর পর তিনবার ভুল রিপোর্টের শিকার আরেক রোগী জাহানারা বেগম জানান, ‘তার ডান পায়ের ভুল জায়গা থেকে ছবি তোলার কারণে শনিবারসহ সবমিলিয়ে তৃতীয়বারের মতো ছবি তোলা হয়েছে তাঁর। এর জন্য ঘুরতে হয়েছে দুইদিন। তিনিও ক্ষুব্ধভাব প্রকাশ করে বলেন, এভাবে মানুষ হয়রানি হলে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে কেন আসবে। টাকা বেশি লাগলেও বাইরেই এক্স-রে করাতে হবে। তাও হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।‘
আরেক রোগী জুলফিকার রহমন বলেন, ‘তিনি তানোর থেকে শনিবার সকালে আসেন বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে। বুকের সমস্যার কারণে বর্হিবিভাগের চিকিৎসক তাঁকেও এক্স-রে করাতে পাঠান। রেডিওলজি বিভাগে আসামাত্র একজন অপরিচিত ব্যক্তি দ্রুত এক্স-রে করে দেওয়ার কথা বলে তাঁর নিকট থেকে ৩০০ টাকা হাতিয়ে নেয়। এরপর তার হাতে ধরে দেওয়া হয় ২২০ টাকার রশিদ। কিন্তু দুপুর পার হয়ে গেলেও তাকে সেই রিপোর্ট দেওয়া হয়নি। একই ধরনের অভিযোগ করেন আরও বেশ কয়েকজন রোগী। তাদের অভিযোগ দালালদের দ্বারা তারা প্রতারিত ও ভুল রিপোর্ট পেয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন।
ওই বিভাগে একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েকজন স্থানীয় দালাল নির্ভর হয়ে পড়েছে এ বিভাগটি। এর মধ্যে একজন রয়েছে বাবু নামের। সেই মূলত দালাল সিন্ডিকেট গড়ে তোলে দ্রুত রিপোর্ট দেওয়ার কথা বলে অর্থ আদায় করছে গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের নিকট থেকে। এ ক্ষেত্রে তারা পকেটে ভরছে ৫০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতারণার শিকার হচ্ছে ওইসব রোগীরা। পরে রোগীরা দ্রুত রিপোর্ট চাইতে গেলেও তাদের সঙ্গে কারাপ আচরণ করা হচ্ছে। কখনো কখনো দালাল বা এক্স-রে বিভাগের টেকনিশয়ানদের হাতে লাঞ্চিতও হচ্ছে রোগীরা।
এক্স-রে বিভাগ সূত্র মতে, এ বিভাগে সবমিলিয়ে ১২ জন টেকনিশিয়ান রয়েছেন। এর মধ্যে ৯ জন পদধারি এবং ৩জন রয়েছেন ডেপুটিশনে। এই ১২ জনের জনবল দিয়েও বিভাগটি সঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। অধিকাংশ সময়ই একজন করে টেকনিশিয়ান দিয়ে চলে বিভাগটি। এতে করে রাজশাহী ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনলজি অথবা প্রাইভেট হেলথ টেকনলজিগুলো থেকে আসা শিক্ষানবিশ শিক্ষার্থীদের দ্বারাই চালানো হচ্ছে এ ডিপার্টমেন্টটি। ফলে ভুলের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
গতকাল অন্তত ১২ জনি শিক্ষার্থীকে দল বেধে ওই বিভাগে রোগীদের এক্স-রে করাতে দেখা যায়। তাঁরাই মূলত রোগীকে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে মেশিনের ওপরে বসানো বা শোয়ানোর কাজটি করছেন। এমনকি মেশিনের সুইচও টিপছেন তাঁরাই। আর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছিলেন একজন টেকিনিশিয়ান। এক্স-রে বিভাগের এমন কর্মকান্ড ও ভুল রিরেপার্ট সম্পর্কে কথা বলার জন্য ওই বিভাগের ইনচার্জ রেজাউল করিম বলেন, ‘খুব বেশি ভুল হয় না। দুই-একটি ভুল হতেই পারে। আমরা সেগুলো সংশোধন করে দেয়। আর শিক্ষার্থীরা আসে শেখার জন্য। তারা কাজের সুযোগ না পেলে শিখবে কোথায়।’
রেজাউল করিম আরো বলেন, ‘আমরা নিয়মিতই দায়িত্ব পালন করি। কোনো দালালদের দ্বারা এখানে কাজ করানো হয় না। যদি হয়, সেটি বাইরে হয়।’ এদিকে সিটি স্ক্যান মেশিনটি বেশকিছুদিন ধরে অকেজো হয়ে থাকায় বাইরে থেকে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে সিটি স্ক্যান করাতে হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন এ বিবাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। তারা বলেন, বাইরে সিটি স্ক্যান করাতে দুই-চার হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। কিন্তু হাসপাতালে সর্বোচ্চ খরচ হয় ১২ শ টাকা। ব্যয়বহুল এই সিটি স্ক্যানের টাকা সংগ্রহ করতে না পেরে অনেকেই চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি করেন বিভাগের দায়িত্বরতরা। রেডিওলজি বিভাগ নিয়ে জানতে চাইলে বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান বলেন, জোড়া-তালি দিয়ে চলছে এক্স-রে বিভাগ। মান্ধাতার আমলের পুরাতন এক্সরে মেশিন আর সিটি স্ক্যান মেশিনটি বারবার অকেজো হয়ে পড়ে। তারপরেও এক্সরে বিভাগটি সচল রয়েছে। তবে ভুল রিপোর্ট দুই-একটি হলেও আমরা সেগুলো সংশোধন করে দেয়। এটি করাতে নতুন করে কোনো অর্থ আদায় করা হয় না।’