দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৮ মে: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপকভাবে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি।নির্বাচন পরবর্তী পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট প্রকাশ করে টিআইব বলেছে, ইসির যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যোগ্য ও নিজ বুদ্ধিতে কাজ করার মতো মেরুদণ্ডবান নির্বাচন কমিশন দরকার বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা।তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো বিষয় নয়। নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন জায়গায় শক্ত, নিরপেক্ষ, সুযোগ্য ও মেরুদণ্ডবান ব্যক্তি দরকার। নিজ বুদ্ধিতে কাজ করার মতো কমিশন হলে অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। সোমবার রাজধানীর ধানমণ্ডিস্থ টিআইবি কার্যালয়ে সংগঠনটির গবেষণা প্রতিবেদন ঢাকা উত্তর, ঢাক দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন ২০১৫: প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন শামসুল হুদা।
সদ্য সমাপ্ত ৩ সিটি নির্বাচের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, প্রত্যেক নির্বাচনেই দেখা যায় কিছু আইন থাকে। তবে সব প্রার্থীরাই এই আইন ভাঙেন। কমিশন সাময়িক কিছু নোটিশ দিলেও ক্ষমতাসীনদের ব্যাপারে একেবারে নিরব ভূমিকা পালন করেন। একাধিক প্রার্থী নিজে ও দলীয়ভাবে অনিয়মে জড়িয়ে পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেন না কমিশন।সাবেক এই সিইসি বলেন, ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে স্বচ্ছ ভোটদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এতে জাল ভোটের কোনো সুযোগ নেই। সিটি নির্বাচনে ফের জাল ভোটের প্রচলন করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা যে গণতান্ত্রিক পথে হাঁটছিলাম তা আজ থেমে গেছে। এর দায়ভায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে।নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন হলো ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার প্রক্রিয়া। ভোট কেন্দ্রে সব প্রার্থী পোলিং এজেন্ট না থাকলে বা এক দলের থাকলে ভোট হয় না। ভোটে অনিয়ম দেখার জন্যই সব দলের পোলিং এজেন্টস রাখা হয়। এই নির্বাচনে সেটি হয়নি।
শামসুল হুদা বলেন, সিটি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি না করায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।এতে কমিশনের দুর্বল নেতৃত্বের প্রকাশ পেয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তাছাড়া সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যয়ের সীমা অনেক বেড়েছে। এতোবেশি ব্যয় করে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীদের টাকা তুলতে হয়। প্রার্থীদের ব্যয়ের সীমার বিষয়ে কঠোর না হওয়ায় এমনটি হচ্ছে। এতে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান এ নির্বাহী।টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এই সদস্য বলেন, সম্প্রতি সমাপ্ত হওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসি নিজেই সেনা মোতায়েনের বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেৃ। তারা জানতো সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে।‘ইসিকে কারো বুদ্ধিতে চললে হবে না। নিজের বুদ্ধিতেই চলতে হবে,’ বলেন তিনি।
সেনাবাহিনী নির্বাচনের মাঠে থাকলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতো না মন্তব্য করে ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, ‘২০১৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ হতে হবে। নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে আইন অনুযায়ী চলতে হবে। ইসি স্বাধীন, তাদের যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে।তিনি বলেন, ওই নির্বাচনকালীন সময়ে যারা ইসির নেতৃত্বে থাকবেন তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখতে হবে।সাবেক সিইসি ড. এ টি এম শামসুল হুদা আরও বলেন, সম্প্রতি তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে যেসব সমালোচনা হয়েছে তার দায় ভার বর্তমান ইলেকশন কমিশনের। সমালোচনার দায় ভার তারা এড়াতে পারবেন না।বক্তব্যে ভোটে কারচুপি এড়াতে ইলেকট্রনিক মেশিনের গুরুত্বের কথাও তুলে ধরে তিনি।সাবেক সিইসি বলেন, ভারতে পরপর সাতটি লোকসভা নির্বাচন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে হয়েছে। আমাদের দেশে এটা হলে এসব পরিস্থিতি হতো না।বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ মেশিনের বিরোধিতা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যখন এ মেশিনের কথা বলেছি বিএনপির পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। এখন তারাই উপলব্ধি করতে পারছে।সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) চালুর পক্ষে মত দেন সাবেক এই সিইসি।অনলাইনে নির্বাচনী প্রচারণার দিকে জোর দিয়ে ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে ফিজিক্যালি নির্বাচনী ক্যাম্পেইন হয়, তা বিশ্বের আর কোন দেশে হয় বলে মনে হয় না! দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে হলেও তা এতো না।ফিজিক্যালি প্রচারণাকালে জনদুর্ভোগ বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিটি নির্বাচনে শান্তি সৃষ্টির একটা সম্ভবনা দেখা দিয়েছিল।সব দল অংশ নিলেও নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা সবাইকে হতাশ করেছে।তিনি বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা রাজনৈতিক প্রভাবে কাজ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পালন করেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদান করা হয়েছে।টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, নির্বাচন দলীয় না হলেও দলীয় ব্যানারেই নির্বাচন করেছে সবাই। প্রার্থীরা ব্যয়সীমার অনেক বেশি ব্যয় করেছেন। দলীয় সমর্থন পেতে অর্থের লেনদেন করেছেন অনেক প্রার্থী। নির্বাচনে জাল ভোট ও অনেক কেন্দ্র দখল করেছে সরকার দলীয় প্রার্থীরা।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তিন সিটি করপোরেশনের ১৩৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টিকে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১৬ ফেব্র“য়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ জন মেয়র এবং ১০১ জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপর গবেষণাটি চালানো হয়। তবে এই পর্যবেক্ষণ সব প্রার্থী ও কেন্দ্রের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়।গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা উত্তরে নির্ধারিত ৫০ লাখ টাকার বেশি তিনজন মেয়র প্রার্থী প্রায় ২০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন।ঢাকা দক্ষিণে তিনজন মেয়র প্রার্থী অনুমোদিত ৩০ লাখ টাকার চেয়ে ব্যয় করেছেন এক কোটি ৪৬ লাখ থেকে ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা।আর চট্টগ্রামে তিন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ কোটি ৪৭ লাখ থেকে সর্বনিম্ন ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ের চিত্র পাওয়া গেছে, যদিও কমিশনের অনুমোদিত ব্যয় সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা।
মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে অবৈধ’ অর্থ প্রদানে প্রার্থী নিজে ছাড়াও স্থানীয় ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তাদের অর্থ দিয়েছেন।তবে ঢাকার দুই সিটির তুলনায় চট্টগ্রামের মেয়র ও কাউন্সিলর পট্রার্থীরা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করেছেন বলে ওই প্রতিবেতনে প্রকাশ করা হয়।অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের সারাংশ উত্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. রেযাউল করিম।গবেষণায় কাজ করেছেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায় ও তাসলিমা আক্তার।সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড.ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।