দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৫ মে ২০১৫: ভয়ের পর ভয় নিয়ে দিন পার করছে বিএনপি।বলাবলি হচ্ছে বিএনপিতে এখন যত ভয়।ক্রসফায়ার, গুম, মামলা, জেল, চার্জশিট আতঙ্কের পর এখন নিখোঁজের পর মানসিক ভারসাম্যহীনভাবে উদ্ধারের ভয় যুক্ত হয়েছে। দুই মাসেরও বেশি সময় নিখোঁজ থাকার পর দলটির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের রহস্যজনক সন্ধান মিলেছে পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয়ের একটি মানসিক হাসপাতালে। নিখোঁজ সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্ধান পাওয়ায় বিএনপির নেতারা খুশি হলেও তার পরিণতি দেখে অনেকেই আতঙ্কিত। সালাহউদ্দিন আহমেদের সন্ধানের পর যেখানে দেশজুড়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ, মানুষ খুঁজছে নানা প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু বিএনপি ও দলের নেতারা বিষয়টি নিয়ে খুব একটা মুখ খুলছেন না। বিএনপির মুখপাত্র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, সালাহউদ্দিনের প্রকৃত অবস্থা জানা দরকার। তার পরিবারের সদস্যরা দ্রুত মেঘালয়ে যাবেন। তখন তার প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে। এরপর বিএনপি এ বিষয়ে বক্তব্য দেবে।
জানা গেছে, তিন মাসের আন্দোলনে বিরতি দিয়ে আপাতত সংগঠন গোছানোর সিদ্ধান্ত নিলেও মামলা ও কারাবন্দি নেতাদের জামিন না হলেও সে উদ্যোগও শুরু করতে পারছে না দলটি। তার মধ্যে একের পর এক ঘটনায় কোণঠাসা অবস্থার মধ্যে ফেলেছে বিএনপিকে। তিন মাসের টানা অবরোধ-হরতালের সরকারবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে এসেও যেন নিস্তার মিলছে না দলটির। আন্দোলন থেকে সরে আসার পরপরই নাশকতার মামলায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে যাত্রবাড়ীতে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা মামলার ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ ৩৮ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদসহ ৩৩ নেতার বিরুদ্ধে অপর একটি মামলায় গতকাল চার্জশিট দেয়া হয়েছে। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক চার্জশিট দেয়া হলেও আতঙ্ক আর ভয়ের কারণে নেতাকর্মীরা ওইভাবে রাজপথে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচিও দেয়া হচ্ছে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, দিনের পর দিন কারাগারে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারাগারের বাইরে যারা রয়েছেন তাদের নামেও দেয়া হচ্ছে নাশকতার মামলায় চার্জশিট। বহু নেতা বিদেশে থেকেও মামলার আসামি। এ অবস্থায় দলের নেতাকর্মীরা স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতেও ভয় পাচ্ছে। একদিকে কারাগারে আটক নেতাদের মুক্ত করা ও বাইরে যারা রয়েছেন তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা বিএনপির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর একের পর ঘটনা নেতাকর্মীদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
টানা তিন মাসের অবরোধ হরতাল কর্মসূচি চালিয়ে বিএনপি তাদের নতুন জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অংশগ্রহণ করে। তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল ঘরে তুলতে না পারলেও দলটি তাদের অবরোধ-হরতালের কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসতে সফল হয়েছে। আপাতত সরকার বিরোধী আন্দোলনের দরজা বন্ধ করে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তিন মাসের লাগাতার অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল নেতৃত্ব মামলার জালে বন্দি। শত শত নেতাকর্মী জেলে। এর মধ্যে একটি ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই আরেকটি ধাক্কার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। গত ৩ মে রাজশাহী কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু মারা যান। তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে রাজশাহী নেয়ার ৫-৬ দিনের মধ্যে তার মৃত্যু হয়। কারাগারে পিন্টুর মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, মানসিক নির্যাতন ও যথাযথ চিকিৎসা না দেয়ার ফলেই পিন্টুর মৃত্যু হয়েছে। নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যুর পরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কাশিমপুর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে কারাকর্তৃপক্ষ দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তারের পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাকে আবার কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়। গত সপ্তাহেই কারাগারে বন্দি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মাথা ঘুরে পড়ে যান। দিনের পর দিন কারাগারে বন্দি থাকতে থাকতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাইরে যারা রয়েছেন তারাও ভয় আতঙ্কের মধ্যেই রয়েছেন। এ অবস্থায় জীবনের নিরাপত্তা, সুস্থভাবে জেলের বাইরে থাকাটাই যেন অনেক নেতার কাছেই বড় হয়ে উঠেছে। তাই গুটিকয়েক নেতা ছাড়া অধিকাংশ নেতাই স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন না। ভয় পাচ্ছেন। তৃণমূলের অবস্থা আরো খারাপ।
একটি সূত্র জানায়,দলের নেতাকর্মীদের আতঙ্কে থাকার বিষয়টি নিজেও উপলব্ধি করতে পারছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি চাইছেন বর্তমান শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে আগে দলের নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে। সারাদেশে আন্দোলনে নেতাকর্মীরা কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন তার প্রতিবেদন তৈরি করতে সম্প্রতি তিনি দফতরের একজন নেতাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। যাত্রাবাড়ীর মামলায় চার্জশিট হওয়ার পর কয়েক পেশাজীবী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে কর্মসূচি দেয়ার পরার্মশ দেন। জবাবে তিনি বলেছেন, আমি নেতাকর্মীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারব না। গত বুধবার গণমাধ্যমে এক বিবৃতির মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি নেতার মুক্তি দাবি করে রাজনৈতিক সহাবস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। খালেদা জিয়া বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত বিরোধীদলকে দমনের হীন উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মিথ্যা ফৌজদারি মামলা এবং সরকারের আজ্ঞাবহ দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা সাজানো মোকদ্দমায় দীর্ঘদিন ধরে এসব নেতার অনেককেই বিনা বিচারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আটকাবস্থায় বেআইনি ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে দফায় দফায় পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে এই রাজনৈতিক বন্দিদের অনেকের ওপর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদের অনেকে বয়সে প্রবীণ এবং নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। কারাগারে সুচিকিৎসার অভাবে তারা অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কারাগারে চিকিৎসার অবহেলায় নাসির উদ্দিন পিন্টুর কথাও উল্লেখ করেছেন।
এদিকে, অবশেষে তৃণমূলের ক্ষয়ক্ষতির খবর নিতে উদ্যোগী হয়েছে বিএনপি।প্রয়োজনের সময়ে খোঁজখবর না নেওয়া ও প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ জমছিলো তৃণমূলে। কিন্তু টানা আন্দোলন-সংগ্রামে ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান ছিলো না কেন্দ্রের কাছে।এ নিয়ে দলের ভেতরেই নানামুখী সমালোচনা ও দাবির প্রেক্ষিতে দেরিতে হলেও নড়েচড়ে বসে বিএনপির হাইকমান্ড। আন্দোলনে ক্ষান্ত দিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘরে ফেরার প্রায় ৪০ দিন পর তার দল তৃণমূলের খোঁজ নিতে উদ্যোগী হয়।দলীয় সূত্র বলছে, টানা অবরোধ ও দফায় দফায় দেওয়া হরতালে হতাহত ও মামলায় খাঁড়ায় পড়া নেতাকর্মীদের তথ্য চেয়ে বৃহস্পতিবার একটি চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্র। দলের দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটি সব মহানগর, ৭৬টি সাংগঠনিক জেলা, উপজেলা ও থানা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।খালেদা জিয়ার নির্দেশনায় দেওয়া এই চিঠিতে কেন্দ্র ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে। বিষয়টি সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন দলের যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান।
দলীয় সূত্র জানায়, সব কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর পাঠানো এ চিঠিতে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের বিষয়ে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে কে, কোন দিন, কোথায়, কীভাবে, কার হাতে মারা গেছে বা পঙ্গু হয়েছে এবং কে, কোথা থেকে, সন্দেহভাজন কার হাতে অপহৃত হয়ে গুম হয়েছে ে স বিষয়েও সুনির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে।সূত্র আরও জানায়, যুগ্ম-মহাসচিব মো. শাহজাহান তৃণমূলে যোগাযোগ রেখে চিঠির বিষয়েও কথা বলছেন। এসব চিঠির চাহিদানুসারে যথাযথ ও সুনির্দিষ্ট তথ্য কেন্দ্রকে দিতে তৃণমূলকে নির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। সঠিক তথ্য পেতে তৃণমূলের কী করতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশনা দিচ্ছেন মো. শাহজাহান।বলা হচ্ছে, এতো দিন ধরে আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে খোদ বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও অগোছালো বক্তব্য দিলেও এবার তারই নির্দেশনায় সঠিক তথ্য পেতে চিঠি দিলেন ড. রিপন। মো. শাহজাহানের তত্ত্বাবধানে অল্প সময়ের মধ্যেই তৃণমূল বিএনপি কেন্দ্রকে এ বিষয়ে সঠিক ও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।দলীয় সূত্র বলছে, সঠিক এ তথ্য পেলে আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে সুবিধা হবে কেন্দ্রীয় বিএনপির। বিশেষত, নিহত-গুম-কারারুদ্ধ নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করতে পারবে। পাশাপাশি কারারুদ্ধদের মুক্ত করতে এবং মামলার আসামিদের মামলা থেকে ছাড়িয়ে নিতেও সহজে কাজ করতে পারবে কেন্দ্র।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক আসাদুল করিম শাহীন বলেন, বিষয়টি একেবারেই দলীয় ও গোপনীয়।তবে রিপোর্টটি লেখার সময় পর্যন্ত কোনো তৃণমূল নেতাই কেন্দ্রের এই চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেননি।