দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১১ মে: শুরুতে দাবি করা হতো ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। কিন্তু দালালদের প্রলোভনে পড়ে খুব কমসংখ্যক মানুষই প্রলুদ্ধ হতো। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই সাগর পথে পৌঁছেছিল স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায়। আর এই সফলতা’ দেখিয়ে দালালরা পরে বড় পরিসরে মানব পাচার শুরু করে। শেষটায় মানব পাচার হয়ে যায় এক অর্থে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের হাতিয়ার। এজন্য দালালরাই উল্টো নিজেরা পুঁজি বিনিয়োগ শুরু করে। গড়ে তুলে দেশব্যাপী শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বলা হয়, কক্সবাজার পর্যন্ত পৌঁছানোর টাকা জোগাড় করলেই চলবে। সব মিলিয়ে যানবাহনের ভাড়া বাবদ লাগবে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। বাকি টাকা পরে মালয়েশিয়া পৌঁছে চাকরি করে পরিশোধ করলেই হবে। দালালদের এই আকর্ষণীয় শর্তে অনেকেই সাড়া দেয়। এরপর শুরু হয় সাগরপথে যাত্রা। কিন্তু এদের অনেকেরই পরে ঠিকানা হয় থাইল্যান্ডে মুক্তিপণ আদায়কারীদের আস্তানা বা বন্দি শিবিরে, কারো বা ট্রলারডুবিতে মৃত্যু হয়। মালয়েশিয়া যাবার স্বপ্ন তাদের আর কোনদিনই পূরণ হয় না।
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সমুদ্র উপকূলের অদূরে চারটি নৌযান থেকে সোমবার প্রায় এক হাজার ৪০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর একদিন আগে ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আচেহ প্রদেশের সমুদ্র উপকূলে একটি কাঠের তৈরি নৌযান থেকে প্রায় ৬শ’ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছিল।অন্যদিকে, মালয়েশিয়া উপকূলে সোমবার উদ্ধার হওয়া হাজারোধিক অভিবাসীর মধ্যে ৫৫৫ জনই বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বাকিদের মধ্যে ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা বলেও নিশ্চিত করেছে তারা।বার্তা সংস্থা দৈনিকবার্তা খবরে বলা হয়েছে, এই অভিবাসীরা বাংলাদেশ ও মায়ানমারের । উপকূলে আরও অভিবাসী আসতে পারে বলে ধারণা করছে কর্তৃপক্ষ। সোমবার যে চারটি নৌযান থেকে সহ¯্রাধিক অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো পরিত্যক্ত ছিল।মানবপাচারের সচরাচর গন্তব্য থাইল্যান্ড। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন ‘দাস শিবিরে’ তৈরি গণকবরে দেহাবশেষের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর থাই কর্তৃপক্ষ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে যেতে ইচ্ছুক জাতিগত রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাচারের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।এএফপি জানায়, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূল থেকে পৃথকভাবে এই এক হাজার ৪০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের ভাষ্য, মায়ানমার ও বাংলাদেশের এক হাজারের বেশি অভিবাসী মালয়েশিয়ার উপকূলে আসেন। মানবপাচারকারীরা এই অভিবাসীদের পর্যটন দ্বীপ লংকাবির উপকূলের অগভীর জলে ফেলে যান।লংকাবির উপপুলিশ প্রধান জামিল আহমেদ বলেন, আমাদের ধারণা, তিনটি নৌযানে এক হাজার ১৮ জন অভিবাসী ছিলেন।’ অভিবাসীদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়া অভিবাসীদের সম্পর্কে আচেহর প্রাদেশিক উদ্ধার ও অনুসন্ধান বিভাগের প্রধান বুদিওয়ান বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, আজ খুব ভোরে উত্তর আচেহর উপকূলে অভিবাসীবাহী একটি ভাসমান নৌযান দেখতে পায় ইন্দোনেশিয়ার অনুসন্ধান ও উদ্ধার দল। নৌযানটিতে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের ৪শ’ অভিবাসী ছিলেন।রোববার ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্র উপকূলে উদ্ধার হওয়া কয়েক শ অভিবাসী সম্পর্কে বলা হচ্ছে, মুক্তিপণ আদায় শেষে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে পাচারকারীদের বন্দিশিবির থেকে তাদের ইন্দোনেশিয়ার দিকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একটি গণমাধ্যমে ওই অভিবাসীদের রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ করা হয়।এদিকে, ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় দুটি নৌকা থেকে প্রায় ছয়শ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় জেলেরা।রোববার ইন্দোনেশিয়ার উত্তর উপকূলে আচেহ প্রদেশের কাছে ভাসমান দুটি কাঠের নৌকা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয় বলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য।রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় সপ্তাহখানেক ধরে নৌকাদুটি সাগরে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ভাসছিল। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে শতাধিক নারী ও শিশুও রয়েছে। আচেহ প্রদেশের উদ্ধারকারী বিভাগের প্রধান বুদিওয়ান এএফপিকে জানিয়েছেন, সকালে জেলেদের কাছ থেকে নৌকায় অনেক মানুষের ভাসার খবর পাই।সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি উদ্ধারকারী দল ওই এলাকায় পাঠিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। তারা মিয়ানমার ও বাংলাদেশের নাগরিক।
উদ্ধারকৃতরা মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করছিল বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তা স্টিভ হ্যামিল্টন।তিনি বিবিসিকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে মোট চারটি নৌকা উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছার পর পাচারকারীরা সটকে পড়েছিল। উদ্ধারকৃতরা ভেবেছিল তারা মালয়েশিয়া পৌছে গেছে। কিন্তু উদ্ধারের পর তারা জানতে পারে এটি ইন্দোনেশিয়া।আচেহ সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ এজেন্সির মুখপাত্র মোহাম্মদ আরিফ মুতাকিন রয়টার্সকে বলেন, এ পর্যন্ত যে তথ্য আমরা পেয়েছি, তাতে উদ্ধারকৃতদের অধিকাংশ এসেছে মিয়ানমার থেকে, তারা রোহিঙ্গা মুসলমান।তবে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকরা আছেন, যারা আনুমানিক এক সপ্তাহ আগে থাইল্যান্ড ছেড়ে আসেন বলে কর্তৃপক্ষের ধারণা। ইন্দোনেশিয়া উপকূলে আসার পথে নৌকার মধ্যেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে।উদ্ধারের পর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অসুস্থ অন্তত ৫০ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আচেহর পুলিশ প্রধান আচমাদি।সম্প্রতি থাইল্যান্ডের জঙ্গলে অভিবাসীদের গণকবরের খোঁজ পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমুদ্রপথে মানব পাচার নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয়।
মানবপাচার রোধে থাই কর্তৃপক্ষের কঠোর অভিযানের মধ্যে গত শনিবারও সেখানকার একটি জঙ্গল থেকে জীবিত উদ্ধার করা শতাধিক ব্যক্তিকে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। গত শুক্রবার জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা মানব পাচারের শিকার হয়েছে। এ সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রায় এ বছরের প্রথম তিন মাসে ৩০০ ব্যক্তি মারা গেছেন। ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মারা গেছেন মোট ৬২০ জন। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর নির্যাতনে। অনেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথাও বলেছেন।প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডের সংখলাপ্রদেশে গণকবরে পাওয়া মৃতদেহগুলো বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অভিবাসীদের।গণকবর আবিষ্কারের পর ঘটনার তদন্তে নেমেছে থাই পুলিশ। মানব পাচার কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন সংখলা প্রদেশের এক মেয়র। এছাড়া থাই পুলিশের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও মানবপাচারকারীদের তালিকা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।অন্যদিকে, মালয়েশিয়া উপকূলে সোমবার উদ্ধার হওয়া হাজারোধিক অভিবাসীর মধ্যে ৫৫৫ জনই বাংলাদেশি বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। বাকিদের মধ্যে ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা বলেও নিশ্চিত করেছে তারা।
সোমবার সকালে দেশটির লংকাবি দ্বীপের সমুদ্র সৈকতের কাছ থেকে তিনটি বড় নৌকা থেকে ওই অভিবাসীদের আটক করে স্থানীয় কোস্টকার্ড ও পুলিশ। নৌকা তিনটিতে মোট এক হাজার ১৮ অভিবাসী ছিলেন।লংকাবি পুলিশের পুলিশ প্রধান হারিথ কম আবদুল্লাহ বলেন, তিনটি নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া এই ১০১৮ অবৈধ অভিবাসীর মধ্যে ৫৫৫ জনই বাংলাদেশি। আর ৪৬৩ জন রোহিঙ্গা এবং বাকিরা এ অঞ্চলেরই কোনো দেশের বাসিন্দা। এদের মধ্যে আবার ৯৯ জন নারী ও ৫৪ জন শিশু।হারিথ আবদুল্লাহ জানান, অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার মাটিতে পা রাখা এই লোকদের শিগগির অভিবাসন অধিদফতরের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে, অথবা লাশ হয়েছে। সোমবার মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষের এ খবরের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়াও জানিয়েছে, এদিন দেশটির উত্তর-পশ্চিম উপকূলের আচেহ প্রদেশের জলসীমায় পৌঁছানো একটি বড় নৌকা থেকে বাংলাদেশিসহ প্রায় ৪০০ অভিবাসীকে উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টকার্ড ও পুলিশ। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ আন্দামান ও নিকোবারের কাছাকাছি আচেহ ভূখণ্ডের অবস্থান।প্রদেশটির অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী বিভাগের প্রধান বুদিওয়ান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, উদ্ধার এ ৪০০ অভিবাসীর মধ্যে মায়ানমারের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিরা রয়েছেন। তবে, এদের মধ্যে কতোজন রোহিঙ্গা ও কতোজন বাংলাদেশি রয়েছেন তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বুদিওয়ান।এর আগে, রোববার আচেহ উপকূলে ম্যানতাং পুনতংগামী দু’টি নৌকা থেকে ৬০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এদের আটকের কথা নিশ্চিত করেন জাকার্তায় নিযুক্ত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ডেপুটি চিফ অব মিশন স্টিভ হ্যামিল্টন। তিনি জানান, নারী ও শিশুসহ একটি নৌকায় ৪৩০ জন ছিল, আরেকটিতে ছিল ৭০ জন।সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের প্রাণ হারানোর ঘটনায় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় তোলপাড় চলছে। বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এই দালালদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে এরই মধ্যে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। কিন্তু প্রশাসনের কড়া পদক্ষেপের মধ্যেই ইন্দোনেশিয়া উপকূলে দফায় দফায় অভিবাসী উদ্ধারের খবর আসছে।
কক্সবাজারে কর্মরত গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দালালরা প্রথমে অভিবাসন প্রত্যাশীদের নামের তালিকা তৈরি করে। যাত্রার দিন প্রত্যেকের হাতে ধরিয়ে দেয় একটি মোবাইল ফোন নম্বর। মালয়েশিয়াগামী এসব লোকজন প্রথমে জড়ো হন চট্টগ্রাম রেল স্টেশন বা বাস টার্মিনালে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী দালালরা সবাইকে এক সঙ্গে জড়ো করে কিছু নির্দেশনা দেয়। এরপর বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে তাদেরকে গ্রহণ করে দালাল চক্রের অন্য টিম। এক বা দুই দিন কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করার পর সুযোগ বুঝে গভীর রাতে তাদের তুলে দেয়া হয় ছোট ট্রলারে। প্রতিটি ট্রলারে উঠানো হয় ১৫ থেকে ২৫ জন করে। পরে তাদের তুলে দেয়া হয় গভীর সমুদ্রে অপেক্ষমাণ বড় ট্রলারে। আর বড় ট্রলারে তুলে দেয়ার পর মাথাপিছু ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা বড় ট্রলারে অবস্থানকারী দালালদের কাছ থেকে বুঝে নেয় ছোট ট্রলারে থাকা দালালরা। এভাবেই সাগরপথে পাচারের উদ্দেশ্যে বিক্রি হয়ে যান অভিবাসন প্রত্যাশীরা ।