দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১০ মে: বর্ষবরণে টিএসসিতে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তিসহ ৬ দফা দাবিতে পাল্টা আঘাত কর্মসূচি পালন করার সময় ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ। এতে সংগঠনটির সভাপতি হাসান তারেক, সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম জিলানী শুভ, ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পিটিয়ে ও জলকামান ব্যবহার করে পণ্ড করেছে পুলিশ।পুলিশের পিটুনিতে আহত অন্তত দশজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।পুলিশ দাবি করেছে এ ঘটনায় ৬ জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছে।রোববার দুপুর ১টার দিকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে এ ঘটনা ঘটে।জানা যায়, যৌন নিপীড়ন বিরোধী পাল্টা আঘাত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাওয়ের লক্ষ্যে বেলা ১২টার দিকে মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি ক্যাম্পাসের গুরুত্বপুর্ণ সড়ক প্রদিক্ষণ করে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের দিকে যায়।
ছাত্র ইউনিয়নের এ কর্মসূচি ঠেকাতে পুলিশ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।বিশেষ করে ঢাবি ক্যাম্পাস ও শাহবাগ এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ব্যারিকেড তৈরি করা হয় শাহবাগে।ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলটি শাহবাগের দিকে না গিয়ে উল্টোপথে টিএসসি-কার্জন হল হয়ে ডিএমপি কার্যালয়ের দিকে চলে যায়। প্রধান বিচারপতির বাসভবনের কাছে পুলিশি বাধায় পড়ে মিছিলটি। বাধা পেয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীরা রাস্তায় অবস্থান নেয় এবং নেতারা বক্তব্য দিতে থাকে। অবস্থানের প্রায় আধা ঘণ্টার মাথায় বিনা উসকানিতে পুলিশ ছাত্র নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হয় বলে অভিযোগ করে ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা। পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে সংগঠনের সভাপতি হাসান তারেক, সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম জিলানী শুভ, ঢাবি সভাপতি লিটন নন্দী, মহানগর সাধারণ সম্পাদক সুমন সেন গুপ্ত, সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক রায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি তন্ময় ধর, মিরপুর থানার সভাপতি রাকিবুজ্জান, লালবাগ থানার আহ্বায়ক জিএম রাব্বি, কবি নজরুল কলেজের সভাপতি দীপক শীল, ঢাবি সংসদের কর্মী হাসিব মোহাম্মদ আশিক, নারায়ণগঞ্জ জেলা সংসদের নেতা ইসমত জাহান জো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের নেতা কেএম মুত্তাকীসহ অন্তত ৩০ জন নেতাকর্মী আহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় আটকরা হচ্ছেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল, কর্মী আরিফুল ইসলাম অনিক, তেজগাঁও কলেজের অন্তু নাগ, আশা ইউনিভার্সিটির সাদ্দাম হোসেন ও বুয়েটের অনিক রায়।ছাত্র ইউনিয়নের একটির সূত্র জানিয়েছে, আহত ছাত্রনেতারা চিকিৎসা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। বিকেল ৪টায় মধুর ক্যান্টিনে এ বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলনও ডাকা হয়েছে।ছাত্র ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার এ বিষয়ে বলেন, শান্তিপূর্ণ অবস্থানের ওপর পুলিশের এই নারকীয় তাণ্ডব প্রমাণ করে তারা দোষীদের আড়াল করতে চায়। রাষ্ট্রের এমন ফ্যাসিবাদী আচরণ রুখে দিতে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।এদিকে পুলিশ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আহত পুলিশ সদস্যরা হচ্ছেন- রমনা থানার ওসি (তদন্ত) আলি হোসেন, এসআই কামরুল, নায়েক জাহিদ, কনস্টেবল আরাফাত, কনস্টেবল শাহীন ও কনস্টেবল মোহাম্মদ আরিফুল।রমনা থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, ছাত্র ইউনিয়ন স্মারকলিপি দেয়ার কথা বলে মূলত নাশকতা সৃষ্টির জন্য এসেছিল।তিনি বলেন, তারা পুলিশের তিনটি ব্যারিকেড ( দোয়েল চত্বর, মৎস্যভবন, কাকরাইল মসজিদ মোড়) ভেঙে সর্বশেষ বেইলি রোডের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করে। এখানে তারা ব্যর্থ হয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। তাদের উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। এসময় তিন রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইপ-পাটকেল ছুঁড়ে। এতে ৬ পুলিশ সদস্য আহত হয়।এ ঘটনায় ছাত্র ইউনিয়নের ৫ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে স্বীকার করেন ওসি মশিউর। পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মী রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনারের কার্যালয়ের দিকে যাত্রা করেন। পথে একাধিক স্থানে বাধা পেলেও দুপুর পৌন ১টার দিকে তারা মিন্টো রোডে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের কাছে পৌঁছান।প্রতক্ষদর্শীরা জানান, মিন্টো রোডের মোড়ে মিছিলকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড পার হওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় উভয় পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়।
এ সময় পুলিশ মিছিলকারীদের লাঠিপেটা শুরু করলে আন্দোলনকারীরা ঢিল ছুড়ে জবাব দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ার শেল ও জলকামান ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারিক বলেন এবং পুলিশ দোয়েল চত্বরে, হাই কোর্টের উল্টো পাশে তাদের দুই দফা বাধা দেয়। শেষপর্যন্ত সার্কিট হাউস অফিসার্স ক্লাবের এর উল্টো পাশে আশিয়ান সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টার এলাকায় লাঠিপেটা করে নেতাকরামীদের সরিয়ে দেয়।এতে তিনি নিজে এবং ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক জিএম জিলানী শুভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি লিটন নন্দী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি তন্বয় ধর, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক সুমন সেন গুপ্তসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন তারিক।এদিকে মিছিলকারীদের ঢিলে ছয়জন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন বলে দাবি করেন রমনা থানার ওসি মসিউর রহমান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা জোনের উপ কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, শিক্ষার্থীরা অবরোধ করে যানজট সৃষ্টি করেছিল। তাদের পুলিশ তাদের সরে যেতে বলে এবং দাবি-দাওয়া থাকলে তাদের কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠাতে অনুরোধ করে। কিন্তু তা না সরায় পুলিশ টিয়ার শেল ও ওয়াটার ক্যানন ব্যবহার করে তাদের সরিয়ে দেয়। কোনো হামলা হয়নি। এ ঘটনায় রমনা মডেল থানার পুলিশ ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আলী হোসেন, অপারেশন অফিসার কামরুল ইসলামসহ আরও তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। দুই কর্মকর্তা ছাড়া বাকি তিন জনের নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আহতদের রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।ওসি মশিউর রহমান আরও জানান, আটকৃতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।গত পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় একদল যুবক নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটায়।ওই ঘটনায় পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় গত বৃহস্পতিবার মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ কার্যালয় ঘেরায়ের এই কর্মসূচি দেয় ছাত্র ইউনিয়ন।ঘটনার পর থেকেই দোষীদের গ্রেপ্তার ও জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করাতে প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে ছাত্র ইউনিয়ন ও নারী অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।