দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১০ মে: নড়াইলে এক গৃহবধূকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শ্বশুরবাড়ির লোকদের নির্যাতনের ঘটনায় দোষীদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।একটি রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ রোববার এই আদেশ দেয়।দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না- সে বিষয়ে আগামী ১৮মে জেলা প্রশাসক ও নড়াইলের লোহাগড়া থানার ওসিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউমেন রাইটাস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাই কোর্টে এই রিট আবেদন নিয়ে আসে।আবেদনের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যার্টনি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস। মনজিল মোরশেদ জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কেন দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানাতে চেয়ে রুলও জারি করেছে আদালত। রিট আবেদনের সঙ্গে কয়েকটি পত্রিকায় ওই নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুলিপিও যুক্ত করা হয়।এসব প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামে গৃহবধূ ববিতা খানমকে (২১) চুরির অভিযোগে গত ৩০ এপ্রিল গাছের সঙ্গে বেধে লাঠি দিয়ে পেটায় তার স্বামী সেনা সদস্য শফিকুল শেখ, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর ছালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিন আক্তার, চাচাশ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ ও কাশিপুর ইউপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আজিজুর রহমান আরজু।নির্যাতনের এক পর্যায়ে ববিতা সংজ্ঞা হারান। ওই অবস্থায় তাকে বাজারে নিয়ে একটি দোকানে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে লোহাগড়া থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরে তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।এ ঘটনায় ববিতার মা খাদিজা বেগম গত ৫ মে লোহাগড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ শফিকুলের চাচা হিরু মিয়াসহ (৩৮) দুজনকে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছে
এদিকে, কথিত চুরির অভিযোগে! ববিতা খানম (২১) নামে এক গৃহবধুকে গাছের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গুরুতর আহত ওই গৃহবধু বর্তমানে নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার ৫ দিন পর গৃহবধুর মা খাদিজা বেগম বাদি হয়ে ৭ জনের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। এ বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ববিতার দাবি সে প্রধান নির্যাতনকারী শফিকুলের স্ত্রী। আর শফিকুলের পরিবার এ কথা অস্বীকার করে বলেছেন ববিতা ও তার মা চুরি করতে এসে ধরাপড়ে মারপিটের শিকার হয়েছে। এ খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, লোহাগড়া উপজেলার শালবরাত গ্রামের ছালাম শেখের ছেলে সেনাসদস্য শফিকুল শেখের(২৬) সাথে পার্শ্ববর্তী এড়েন্দা গ্রামের ইসমাইল মোল্যার মেয়ে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী (প্রাইভেট) ববিতার মোবাইল ফোনে প্রেমজ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই প্রেমজ সম্পর্কের জের ধরে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর গোপনে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তার শ্বাশুড়ি তাকে ঘরে তুলে নেবে না বলে তালবাহানা শুরু করে। পরে শফিকুল ববিতার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। স্বামীর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ববিতা হতাশ হয়ে পড়েন। ঘটনার আগের দিন শফিকুল ছুঁটিতে বাড়ি এলে ববিতা খবর পেয়ে শ্বশুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে স্ত্রীর স্বীকৃতি দাবি করেন। ঘটনারদিন ৩০ এপ্রিল সকাল ৭ টার দিকে এ নিয়ে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ববিতার স্বামী, শ্বাশুড়ি, শ্বশুরবাড়ির লোকজন ববিতাকে শ্বশুর বাড়ির পার্শ্ববর্তী গাছের সাথে বেঁধে লাঠিপেটা করে অমানুষিক নির্যাতন করে। এতে ববিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
নির্যাতনের শিকার গুরুতর আহত গৃহবধু ববিতাকে প্রথমে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থা আশংকাজনক হওয়ায় তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সরেজমিন শালবরাত গ্রাম ঘুরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। শফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মা ও অন্যান্য সদস্যদের পাওয়া যায়নি। শফিকুলের চাচি রেখা বেগম ও প্রতিবেশী রেঞ্জিনা বেগম বলেন, ববিতা শফিকুলের স্ত্রী নয়। তাদের বিয়ের কথাও ঠিকনা। ঘটনার দিন ববিতা ও ববিতার মা খোদেজা হঠাৎ শফিকুলদের ঘরে ঢুকে নগদ টাকা, সোনার চেইন নিয়ে নেয় এবং ভাংচুর শুরু করে। এসময় আমরা এবং প্রতিবেশী বাড়ির মহিলারা চোর চোর বলে তাড়া করলে ববিতার মা পালিয়ে যায় এবং ববিতা ধরা পড়ে। এরপর তাকে গাছে বেঁধে মারপিট করি।প্রতিবেশী রেনা বেগম বলেন, চিৎকার শুনে এসে দেখি ববিতাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখা। পরে পাশের গ্রামের আরজু ভাই এসে ববিতাকে উদ্ধার করে থানা ও হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপতালে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত ববিতা সাংবদিকদের বলছেন আরজু নিজেও তাকে মারপিট করেছে।
আজিজুর রহমান আরজু এ প্রতিবেদকের কাছে ওই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, চুরির অভিযোগে পাশের গ্রামে এক গৃহবধুকে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই এবং নির্যাতিত মেয়েটিকে উদ্ধার করে প্রথমে থানায় ও পরে হাসপাতালে নিয়ে আসি। বিষয়টি ওসি সাহেবও জানেন। পরে জানতে পারলাম এ ঘটনায় আমাকেও আসামী করা হয়েছে। শালবরাত গ্রামের কালামের স্ত্রী রতনা নিজেই মারপিট করেছেন স্বীকার করে সাংবদিকদের জানান, বাড়িতে কোন লোক না থাকায় ববিতা ও তার মা ঘরে ঢুকে চুরি করছিল। ববিতা নামের ওই মেয়েটির তিন-চারটি বিয়ে আছে। সে একটা নষ্টা মেয়ে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জনান, বিষয়টি ধামাচাপ দিতেই কথিত চুরির ঘটনা সাজানো হয়েছে।
নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ববিতা সাংবাদিকদের বলেন, ওরা গাছের সাথে বেঁধে পিটিয়ে আমার পরনের জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে এবং অমানুষিক নির্যাতন চালায়। লাঠির আঘাতে আমার হাত ভেঙ্গে গেছে। আমাকে টানাহেচড়া করেছে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে পাশবিক নির্যাতন চালানোর এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। বিয়ের পর থেকেই স্বামী,শ্বশুর,শ্বাশুড়ী মিলে ৫ লাখ টাকা যৌতুক দাবি করছিল। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় আমাকে তারা এর আগেও মারপিট করেছে। আমি গত ৮/৮/২০১৪ তারিখে আদালতে তাদের নামে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা দায়ের করেছিলাম। ওই মামলা তুলে নিতে তারা হুমকিও দিচ্ছিল। এদিকে ববিতার সাথে শফিকুলের বিয়ে হয়েছে ববিতা এ দাবি করলেও কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোরের অভয়নগরের নওয়াপাড়া পৌরসভার মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিষ্ট্রার সুলতান আহমেদ লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, শফিকুল ইসলাম, পিতা- আব্দুস সালাম শেখ, গ্রাম – শালবরাত ও ববিতা খানম, পিতা ইসমাইল, গ্রাম এড়েন্দা উভয় থানা লোহাগড়া,জেলা নড়াইল এর কোন বিবাহ তার অধীনে হয়নি। এমনকি বই নং ১, বালাম নং- ৪৮১৩, পৃষ্ঠা নং- ১৮, ক্রমিক নং-৩১৮,তারিখ-০২/১২/২০১৩ এ ববিতা ও শফিকুল এর বিবাহ সংক্রান্ত তথ্য সঠিক নয়। ঘটনার ৫ দিন পর নির্যাতিত ববিতার মা খাদিজা বেগম বাদি হয়ে জামাই শফিকুল শেখকে প্রধান আসামী করে ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মঙ্গলবার লোহাগড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০(সংশোধন) ২০০৩ এর ১১(গ)১০/৩০ ধারা মূলে মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-০৭,তারিখ ০৫ ০৫ ১৫)।
এ ব্যাপারে লোহাগড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ লুৎফর রহমান জানান, এ ঘটনায় মামলা দায়ের হয়েছে এবং এজাহারভুক্ত ২ জনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ববিতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে নড়াইলের পুলিশ সুপার সরদার রকিবুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।