দৈনিকবার্তা-সিরাজগঞ্জ, ৮ মে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। নোবেল বিজয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকীতে এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলো।প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পর্যায়ে বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
তিনি বলেন, আজকের দিনটি শাহজাদপুরের মানুষের জন্য খুবই আনন্দের দিন। কারণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হতে যাচ্ছে।শেখ হাসিনা বলেন, এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য সিরাজগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হবে। এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্র গবেষণা ও চর্চার পাশাপাশি সাহিত্য, সঙ্গীত, নাট্যকলা, নৃত্য ও চারুকলা, সামাজিক বিজ্ঞান, কৃষি, সমবায়, জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা দেয়া হবে।সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামান।এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও স্থানীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন।এছাড়া সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আখতারী মমতাজ ও সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ভূখন্ড ও এর মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছিল আত্মিক সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের এক বিশেষ পর্বে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে জমিদারি দেখাশোনার জন্য অবস্থান করেছেন। তিনি অন্য জমিদারদের মতো শুধু প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করে কোষাগার স্ফীত করেননি। বরং তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে এর কারণগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করেছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এসব চিন্তা থেকেই রবীন্দ্রনাথ কৃষি আধুনিকায়ন, কৃষি ব্যাংকিং ও বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এসব কর্মকান্ডের সাফল্য ও বিস্তৃতির জন্য তিনি তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকে কৃষি এবং বন্ধু পুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে পশুপালন বিষয়ে শিক।ষার জন্য আমেরিকা পাঠান।তিনি বলেন, আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি বিপ্লবের ক্ষেত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববাংলাকে বেছে নেন। তিনি এ অঞ্চলে নিজের সাড়ে ৪ হাজার বিঘা জমি গোচারণ ভূমি হিসেবে কৃষকদের দান করেন। এর উপর ভিত্তি করে শাহজাদপুরে গড়ে উঠে দুগ্ধ খামার, যা মানুষের আয়-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি করে। এছাড়া মৎস্য চাষের জন্য তিনি দীঘি ও পুকুর খনন করেন। গরীবদের মাঝে নগদ অর্থ সাহায্যের পাশাপাশি বিনা পয়সায় ওষুধও বিতরণ করেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, রবীন্দ্রনাথ কন্যা দায়গ্রস্ত অভিভাবকদের মেয়ের বিয়ের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতেন। শাহজাদপুর প্রথম পরিদর্শনে এসেই তিনি ১ লাখ ৮ হাজার টাকার খাজনা মওকুফ করে দেন।
ক্ষদ্র ঋণ প্রবর্তনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্রনাথই প্রথম এ অঞ্চলে স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণ চালু করেন। নোবেল পুরস্কারের অর্থের প্রায় সবটাই তিনি সমবায় ব্যাংকের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে কৃষকদের দিয়েছেন। তিনি ছিলেন মানুষের মনোজগতের কবি। মানবিক মূল্যবোধ ও আত্মশক্তি জাগরণে তাঁর লেখা চিরকাল প্রেরণা জোগাবে।অন্যদিকে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির কবি। রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু দারুণভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। বিশেষ করে কবিগুরুর দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামে সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছে। জাতির পিতা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বহু আগেই রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’Ñ গীতি কবিতা এ দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।তিনি বলেন, বিশ্বকবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা, আন্তর্জাতিকতাবাদ, মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ভাবনাগুলো বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছিলো।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি রবীন্দ্র আচ্ছন্ন, এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাহিত্যের সকল শাখায় ছিলো তাঁর সরব উপস্থিতি। বিশেষ করে তাঁর গানের বাণী ও সুরে যে কোনো মানুষ মুগ্ধ হতে বাধ্য। মধ্যবিত্ত বাঙালির ওপর রবীন্দ্রনাথের এই প্রভাবের কারণে এক সময় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি গণমাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এ দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও সচেতন মানুষ আইউব সরকারের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছেন।শেখ হাসিনা বলেন, রবীন্দ্র দর্শনের মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিকতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক মানবিক বিশ্বায়নের স্বপ্ন। তাঁর দৃঢ় অব¯’ান আজো আমাদের প্রেরণার উৎস।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে দেশ শুধু ভৌগোলিক সীমারেখা ছিলো নাÑ বরং তিনি দেশকে কল্পনা করতেন সোনার বাংলা রূপে। ১৯৭১-এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের সেই সোনার বাংলার বাস্তব রূপ দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ২০১১ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে সার্ধশত রবীন্দ্র জন্মবর্ষ এবং ২০১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ সাড়ম্বরে উদযাপন করে আমরা সাংস্কৃতিক মৈত্রীর এক অনন্য নজির স্থাপন করেছি।তিনি বলেন, এ বছর আমরা জাতীয় পর্যায়ে শাহজাদপুরে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উদযাপনের জন্য সরকারি কর্মসূচি গ্রহণ করেছি। রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও বিশ্বাস করি, কেবল রাজধানী নয়Ñ জাতির প্রাণ সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। পাশাপাশি দেশে আরো বেশী করে বরীন্দ্রনাথের ওপর চর্চা ও বরীন্দ্র সংস্কৃতির বিকাশে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।শেখ হাসিনা বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের নির্মাণ কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এই ভবনে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার, বাংলাদেশ কর্নার এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর ও বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর পৃথক কর্নার থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু সমবায় ও দরিদ্র লোকদের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার ও তৃণমূলের লোকদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশ প্রতিটি অঞ্চলের সমউন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার একটি অসাম্প্রদায়িক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। আর স্বাধীনতা বিরোধী অশুভ শক্তি দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তবে জনগণ কখনো এই সুযোগ দেবে না।তিনি বলেন, আমরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অনুসারী। তাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন, অন্যায় ও অশুভ শক্তি, অন্যায় ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।শেখ হাসিনা রবীন্দ্রনাথের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে দেশকে গড়ে তুলতে সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সকলের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে একই স্থানে ফলক উন্মোচন করে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, সিরাজগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের বর্ধিত কাজ, মেরিন টেকনোলজি ইনস্টিটিউট, জেলা রেজিস্ট্রার অফিস এবং শেখ রাসেল পৌর শিশু পার্কের উদ্বোধন করেন।প্রধানমন্ত্রী কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং শাহজাদপুরে করতোয়া নদের ওপর নরিনা সেতু নির্মানের অনুমতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।