দৈনিকবার্তা-কলাপাড়া, ৮ মে: থাইল্যান্ডের দালালের নিষ্ঠুর নির্যাতন সইতে না পেরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে মালয়েশিয়া গিয়ে এখন জেলহাজতে রয়েছে কুয়াকাটার চার যুবক। দীর্ঘ তিনমাস এরা থাই দালালের হাতে আটক ছিল। স্থানীয় দালাল জাকির ও জাহাঙ্গীরসহ কক্সবাজারের আব্দুস সালামের মাধ্যমে অবৈধ পথে ট্রলারযোগে মালয়েশিয়ার কথা বলে এদেরকে ভিনদেশী দালালের হাতে তুলে দেয়া হয়। স্থানীয় দুই দালালকে জাল বিক্রি করে চারজনে একলাখ টাকা দেয়। বাকি টাকা মালয়শিয়া পৌছে দেয়ার কথা ছিল। এসব হতভাগাদের পরিবারে এখন চলছে এক ধরনের আহাজারি। ঘুরছেন প্রিয়জনকে উদ্ধারের জন্য এদ্বার-ওদ্বার।
কুয়াকাটার আব্দুল খালেকের ছেলে আলমগীর (২৭), বাদশা মিয়ার ছেলে মিরাজ(২৬), লতিফ মিস্ত্রির ছেলে আল আমিন(২৫) ও আলীপুর বাজারের জালাল মাঝির ছেলে বাহাদুরকে (২৮) দালালচক্র মালয়শিয়া পাঠানোর কথা বলে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ফেলে আসে। থাই দাললরা তিনমাস তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায় বলে এদের পরিবারের অভিযোগ। এক পর্যায়ে পালিয়ে মালয়শিয়ার টেরালিস কেবিএন এলাকায় পৌছলে ৫ মে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তারা।
ভিসার সামান্য ত্রুটি থাকার অজুহাতে ১৪ দিন জেল খেটে বের হওয়া সিরাজ নামের এক বাংলাদেশী মালায়শিয়া থেকে শুক্রবার এ চার যুবকের অভিভাবকদের কাছে ফোন করেন। সিরাজ কথা বলেন স্থানীয় একাধিক সংবাদকর্মীর সঙ্গে। তিনি লোমহর্ষক নির্যাতনের কথা জানান ফোনের মাধ্যমে। সিরাজের বাড়ি যশোরে বলে তিনি জানান।
সিরাজ জানান, তার ভিসায় কর্মস্থল এক জেলায় আর কাজ করছিলেন অন্য জেলায়। একারনে তাকে জেলে আটক থাকতে হয়। এ সুযোগে কুয়াকাটার আটক ওই চারজনের সঙ্গে তার বিস্তারিত কথা হয়। সিরাজ দাবি করেন, কুয়াকাটার চারজনকে কুড়ি হাজার টাকার মাসিক বেতনে জাহাজে চাকরি দেয়ার কথা বলে দালালরা পাচার করে দেয়। স্থানীয় দালাল লতাচাপলী ইউনিয়নের তাজেপাড়া গ্রামের জাকির ও জাহাঙ্গির এ চার জনকে কক্সবাজার টেকনাফের দালাল আব্দুস সালামের হাতে তুলে দেয়।
জেলে আটক চার যুবকের উদ্ধৃতি দিয়ে সিরাজ আরও জানান, ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ৪০-৪৫ জনের একটি দলকে প্রথমে একটি ভবনের কক্ষে রাখা হয়। এরপর প্রত্যেকের সঙ্গে থাকা অতিরিক্ত কাপড়-চোপড়, মোবাইলসহ টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়া হয়। এক কাপড়ে একটি ট্রলারে সবাইকে তুলে দেয়া হয়। প্রতিবাদ করলে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। সামান্য রুটি আর পানি খেয়ে দুই দিন দুই রাত পার করে থাইল্যান্ডের একটি জঙ্গলে সবাইকে তুলে দেয়া হয়। সেখানকার দালালরা দিনের পরে দিন জঙ্গলে হাটিয়ে এক সময় একটি তাবুর আস্তানায় জড়ো করে। এভাবে অন্তত ত্রিশটি আস্তানা তারা জঙ্গলে দেখেছে। সেখানে আটকা রয়েছে আরও শত শত মানুষ। সবাই বাংলাদেশী। সবাইকে একদিন পর পর একটি করে রুটি খেতে দেয়া হতো। এর পর শুরু হয় দালালদের মাধ্যমে বাড়িতে ফোন করানো। চাওয়া হয় জনপ্রতি আড়াই লাখ টাকা। নইলে লাশ ফেলার হুমকি দেয়া হয়। যারা টাকা পাঠাতে পারে না তাদের অনেককে পিটিয়ে খুন করা হতো। আবার কাউকে গুলি করে মেরে ফেলত। এছাড়া থাই জঙ্গলের বিশধর সাপসহ পোকামাকড়ের কামড়ে অনেকে মারা যেত। জঙ্গলে কবর খুড়ে মাটি চাপা দেয়া হতো নিহতদের। এসব বিভৎস বর্বর নির্যাতন থেকে নিজেদের বাচাতে কুয়াকাটার চার জেলে গভীর রাতে পাহারাদারদের চোখ ফাকি দিয়ে মালয়শিয়ার বর্ডার এলাকায় গিয়ে পৌছে। কয়েকদিন গাছের পাতা ফলমূল খেয়ে তারা লোকালয় পৌছায়। আটক হয় পুলিশের হাতে। সিরাজের বর্ণনা ছিল লোমহর্ষক। এসব শোনার পরে এ চার যুবকের পরিবারের লোকজন কান্না জুড়ে দেয়।
স্থানীয় দালাল জাকিরের বাড়িতে গেলে তার পরিবার জানায় জাকিরও থাইল্যান্ডে আটক রয়েছে। আর জাহাঙ্গীরের বসতঘরে তালা ঝুলছে। পরিবারসহ উধাও হয়েছে। তিনমাস নিঁেখাজ থাকার পরে শুক্রবার চার যুবকের মালয়েশিয়া হাজতবাসের খবর শুনে সজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানান সবাই।