‘আজি হতে শতর্বষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ শত কৌতূহল ভরে/ অথবা, আজি হতে শতর্বষ পরে/ এখন করিছো গান সে কোন্ নুতন কবি/ তোমাদের ঘরে। ’
দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ৮ মে, ২০১৫ : কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশ’ বছরেরও বেশী আগে বাঙ্গালী পাঠকদের প্রতি এ জিঞ্জাসা করেছিলেন। সেই চিরজাগরুক, বাঙালীর আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের অন্যতম শীর্ষ রুপকার, কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ শ্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী । নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নোভেল বিজয়ী এই বাঙ্গালি কবিকে স্মরণ করবে তার অগুণিত ভক্তরা। শুধু দুই বাংলার বাঙালীই নয়, পুরো ভারতবাসী এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলা ভাষাভাষী,অন্য ভাষার ভক্তরা কবির জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়।
এবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সভ্যতার সংকট ও রবীন্দ্রনাথ’। এর আগে পালিত হয়েছে তার সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। লাখো কন্ঠে গাওয়া হয়েছে তাঁর লেখা ‘আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালোবাসি ’। শুধু তাই নয় এ বছর অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলার মাঠে দুটি দেশের (বাংলাদেশ ,ভারত ) ক্রিকেট খেলোয়ার খেলা শুরুর আগে মাথা নুইয়েছেন তার সৃষ্টির সামনে। এসব কি প্রমাণ করে না একশ’ বছর আগে তিনি যে আশংকা করেছিলেন তা ছিল একেবারেই অমূলক। আমাদের নানা সংকট-আনন্দ-বেদনায়, আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্র সৃষ্টি আমাদের চেতনায় বরাবর স্পর্শ করছে এবং করবে আরো শত শত বছর পরেও- বাঙ্গালি মাত্রেই তা বোধ হয় বলতে পারেন।
কবির আশংকার জবাবে বলা যায় শত বছর পরে এখন অনেক নতুন কবি এসেছেন, নব নব সৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত স্ফীত হচ্ছে আমাদের সাহিত্য এবং সংগীতের ভূবন। তারপরেও বাাঙলির জীবনে ভিন্নমাত্রায়,নানা সাধণায় রবীন্দ্রনাথ মাত্র একজনই। নবীন,প্রবীণ, যুবক, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মাঝি-মাল্লা, কামার-কুমার সবার মাঝে রবীন্দ্রনাথ জাগরুক আজও। এই অঞ্চল শুধু সমগ্র বিশ্বের মানুষের বড় অবলম্বন তার সৃষ্ট সাহিত্য সমগ্র। এখনো জীবনের সবকিছুতে হাত বাড়াতে হয় রবীন্দ্রনাথের দিকে। শান্তি, সাম্য, ঐক্য, মানববতার কাতারে, সকল জঞ্জালের বিরুদ্ধে তার কালজয়ী কবিতা, নাটক, ছোট গল্প, উপন্যাস, গান বাঙালির চিরকালের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। বাতিঘরের মতো আলোয় উদ্ভাসিত রাখছনে কবি রবীন্দ্রনাথ। তাই কবির বসন্ত গান শতবছর পরেও ধবনিত হয় নবীন কবি আর পাঠকের বসন্ত দিনে। জন্মের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে এবং মৃত্যুর প্রায় ৭৪ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ এখনও কেন প্রাসঙ্গিক-এ ব্যাপারে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাঙালীর এই কবি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন, চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর, বাংলাভাষা ছিল অপরিণত।
[su_carousel source=”media: 36508,36507,36506,36505,36504,36503,36502,36495,36496,36497,36498,36499,36500,36501,36494,36493,36492,36491,36490,36489,36488,36481,36482,36483,36484,36485,36486,36487,36480,36479″ limit=”30″ link=”lightbox” title=”no”]
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ একাধারে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তা জগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালীর মানস গঠনে পালন করেছেন অগ্রদূতের ভূমিকা। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যোগানোর মধ্যদিয়ে বাঙালী মননকে বিশ্বমানে উন্নীত করে জাতিকে আবদ্ধ করে গেছেন চিরকৃতজ্ঞতায়। দেড়শত বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে তাই চিরজাগরূক হয়ে আছেন। জাতীয় পর্যায়ে কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদ্যাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ বছর জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজাদপুরের পাইলট হাইস্কুল মাঠে সকাল ১০টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ হাসিবুর রহমান স্বপন উপস্থিত থাকবেন। স্বাগত বক্তৃতা দেবেন ভারপ্রাপ্ত সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ। রবীন্দ্র স্মারক বক্তা হিসেবে এমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান উপস্থিত থাকবেন।
ওইদিন বিকেলে এবং পরবর্তী তিনদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবির চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওঁগার পতিসর ও খুলনার দক্ষিণডিহিতে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তার ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে। স্থানীয় প্রশাসন এ উপলক্ষে রবীন্দ্রমেলা, রবীন্দ্রবিষয়ক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমি কবিগুরুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযোগ্য মর্যাদায় কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করবে। কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ৯ মে শনিবার বাংলা একাডেমিতে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদ্যাপন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলসমূহ ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করবে। কবিগুরুর ১৫৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জাতীয় পর্যায়ে মূল অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানসমূহে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রদান করবে।
রবীন্দ্রনাথ ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁেকার ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস যোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাসমূহ প্রাণের সঞ্চার করে। আমাদের প্রতিটি সংগ্রামেই শুধু নয়, কবির চিরায়ত রচনাসমগ্র আজীবন স্মরণের র্র্শীষতায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
কবির লেখা গান ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কবির বিভিন্ন রচনা স্বাধীনতা অজর্নে বিপুল প্রেরণা যুগিয়েছিল। এ জাতির সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সঙ্গীত, নাটক, চলচ্চিত্র, কথাসািহত্য, কৃষি, সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদের জাগরণে কবি রবীন্দ্রনাথ পথিকৃতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।