দৈনিকবার্তা-লালমনিরহাট, ৭ মে: বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত চুক্তি ভারতীয় লোকসভায় অনুমোদন হওয়ার পর লালমনিরহাটের ছিটমহল গুলোতে চলছে আনন্দ উৎসব। বৃহস্পতিবার জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী ছিটমহলের বাসিন্দারা মিষ্টি বিতরণের পাশাপাশি আনন্দ মিছিল বের করে। আর বিলটি পাস হওয়ার ফলে দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত যে বিরোধ ছিল তার অবসান হওয়ার পাশাপাশি দু’দেশের সীমান্তে নতুন দুয়ার খুলল। ছিটমহলবাসী ১৯৪৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬৭ বছর পর বন্দি জীবন থেকে মুক্তির আলোর মুখ দেখছেন। ছিটমহলবাসী ফিরে পেল তাদের পরিচয়। এতদিন নাগরিকত্ব না থাকা কার্যত এক ধরনের রাষ্ট্রহীন’ এসব মানুষ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই অমানবিক জীবন যাপন করে আসছেন।
লালমনিরহাটের উত্তর গোতামারীর ছিটমহলের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম জানান, অনেক দিন পর হামা পরিচয় পাইনো বাহে, এলা হামার ছাওয়া-পোয়া পড়ালেখা করবার পাইবে, এখন হামা বাংলাদেশের মানুষ। হামার ছাওয়া-পোয়া বাংলাদেশত চাকরী-ব্যবসা করির পাইবে।চুক্তি অনুযায়ী, ভারতে বাংলাদেশি ছিটমহল রয়েছে ৫১টি। এর মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ১১০ একর। অন্য দিকে বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। এ জমির পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ১৬০ একর।জানা গেছে, ভারতের ভেতরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার অধীনে ১৮টি ও লালমনিরহাট জেলার অধীনে ৩৩টি। এগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে। বাংলাদেশের ভেতরে থাকা ভারতের ছিটমহলের ১১১টিই পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি, লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি এবং নীলফামারীতে অবস্থিত ৪টি। লালমনিরহাট জেলা ছিটমহল বিনিময় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম জানান, ভারতের মন্ত্রিসভা, রাজ্যসভা ও সর্বশেষ লোকসভায় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বিলটির অনুমোদন হওয়ায় বাংলাদেশ-ভারতের ১৬১টি ছিটমহলবাসীর পক্ষ থেকে দু’দেশের সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা ছিটমহলবাসী দীর্ঘ ৬৭ বছর বন্দি থাকার পর আজ আমরা আলোর মূখ দেখছি। স্থলসীমা চুক্তিটি বাস্তবায়নে আর কোন বাঁধা থাকলো না।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ছিটমহল বা সীমান্ত সমস্যা ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী সৃষ্টি হয়। দু’দেশের বিদ্যমান সীমান্ত সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৭৪ সালে সই হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজ দেশের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। এটি মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হিসেবেই পরিচিত। ওই চুক্তিতেই ছিটমহল বিনিময়ের কথা উলে¬খ করা হয়।২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের তাগাদা দিলে তখনকার কংগ্রেস সরকার এ নিয়ে কাজ শুরু করে। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ে ঢাকা সফরে একটি প্রটোকল সই হয়। এর পর ভারতে রাজ্যসভায় বেশ ক’বার বিলটি উত্থাপিত হলে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ বিরোধী পক্ষের তোপের মুখে পড়েন। আর গত বছর ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভায় বহুল প্রতীক্ষিত সীমান্ত বিল অনুমোদন হয়।
কুড়িগ্রাম: বহুল আলোচিত ও দীর্ঘ দিনের প্রতিক্ষিত স্থল সীমান্ত বিলটি মঙ্গলবার ভারতীয় মন্ত্রী সভায় অনুমোদনের পর বুধবার রাজ্যসভায় পাশ হয়েছে।বৃহস্পতিবার বিলটি লোকসভায় পাশ হলে বন্দী জীবনের অবসান ঘটবে দু’দেশের ১৬২টি ছিটমহলের ৫১ হাজার ৫শ ৮০ জন মানুষের। এরই মধ্যে মুক্তি জীবনের আশায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে ছিটমহল বাসীরা।ভারতের মন্ত্রীসভায় স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন ও রাজ্যসভায় পাশ হওয়ায় মুক্ত জীবনের আশায় আনন্দের জোয়ারে ভাসছে ছিটমহলবাসীরা। ছিটমহলগুলোতে চলছে মিষ্টি বিতরণ, আনন্দ মিছিলসহ নানা আয়োজন। লোক সভায় বিলটি পাশ হলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিট মহলের ৩৭ হাজার ৩শ ৬৯জন মানুষ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিট মহলের ১৪ হাজার ২শ ১১ জন মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্বের সুবিধা পাবে। বিলটি পাশ ও বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ পাবে ১১১টি ছিট মহলের ১৭ হাজার ২শ ৫৮ একর জমি এবং ভারত পাবে ৫১টি ছিট মহলের ৭হাজার ১১০ একর জমি।
১৯৭৪ সালে ছিট মহল বিনিময়ে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে উভয় দেশের ছিটবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এর ধারবাহিকতায় ২০১১ সালে ঢাকায় হাসিনা-মনমোহন প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সালে ভারতের কংগ্রেস সরকার ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তির বিলটি পার্লামেন্টে উথ্যাপনের চেষ্টা করলে পশ্চিম বঙ্গরাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তির মুখে বিলটি আলোর মুখ দেখেনি।নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ছিট মহল বিনিময়ের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। তখন নমনীয় হয় মমতা ব্যানার্জী। ৪ ডিসেম্বর পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের এক জনসভায় ছিটমহলবাসীদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে ছিট বিনিময়ে তার সম্মতির কথা জানায়।কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ার ছড়া ছিটমহলের বাসিন্দা আমেনা জানান, ভারতে ছিট মহলের বিল পাশ হওয়ায় নিজেদের মুক্ত পাখির মতো মনে করছি। আমরা আর বন্দি নই। আমাদের এখানে স্কুল কলেজ হলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়া-লেখা করাতে পারবে।
ফুলবাড়ী উপজেলার অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার নবম শ্রেণীর ছাত্রী শামছুর নাহার জানান, ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে পায়ে হেঁটে ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লেখাপড়া করতে হচ্ছে। ছিট বাংলাদেশ হলে আমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।ফুলবাড়ী উপজেলার কালিরহাট ছিটের বাসিন্দা মোজাফফর হোসেন জানান, দীর্ঘ বঞ্চনার পর মৌলিক অধিকারসহ নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার আশায় আমরা ছিটবাসীরা উদ্বেলিত হয়ে আছি। আমরা আশা করি দ্রুত ছিটমহল বিনিময় করে ছিটবাসীর অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটানো হোক।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, ভারতের মন্ত্রী সভায় অনুমোদনের পর রাজ্যসভায় স্থল সীমান্ত বিলটি পাশ হয়েছে। এতে করে আমাদের ছিটবাসীদের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফল আমরা পেয়েছি। আশাকরি লোকসভায় বিলটি পাশা হওয়ার পর যত তারাতারি সম্ভব তা বাস্তবায়ন করা হবে। ছিটবাসীরা নাগরিকত্ব পেয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরতে-ফিরতে পারবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।বিলটি বৃহস্পতিবার ভারতীয় লোকসভায় পাশ করে দ্রুত ছিট বিনিময়ে এগিয়ে আসবে দু’দেশের সরকার। এমনটাই দাবি এখন ছিটমহলবাসীদের ।