দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ০২ মে: জাতীয় বাজেটে বিভিন্ন খাতে দেওয়া ভর্তুকিতে স্বচ্ছতা নেই।যে লক্ষ্যে দেওয়া হচ্ছে তা-ও অর্জন হচ্ছে না। এ খাতে প্রতিবছর কী পরিমাণ ব্যয় হচ্ছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই তারও। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অব্যাহত ভর্তুকি ক্রমাগত ব্যয় বাড়াচ্ছে।শনিবার রাজধানীর হোটেল লেকশোর-এ বাংলাদেশে ভর্তুকি ব্যবস্থা নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে এ কথা বলেন বক্তারা।এসময় ভর্তুকির সুফল পেতে একটি জাতীয় নীতিমালা করার দাবি জানান অর্থনীতিবিদরা।সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চলনায় সংলাপে অংশ নেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. আসাদুজ্জামান, ইকনোমিক রিসার্চ গ্র“পের (ইআরজি) গবেষণা পরিচালক ড. সাজ্জাদ জাহিদ প্রমুখ।এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক ড. কানিজ সিদ্দিক।
ভর্তুকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে সিপিডি আয়োজিত এক সেমিনারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির তথ্য বিশ্লেষণের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক শামসুল আলম।শনিবার সকালে রাজধানীর লেইক শোর হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ওই সেমিনারে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচক ছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এই সদস্য।অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, প্রবন্ধে বিভিন্ন অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির বরাদ্দ যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা ও সামঞ্জস্যতা নেই।কয়েক বছর ধরে খাদ্য, কৃষি ও বিদ্যুৎসহ বেশ কয়েকটি খাতে ভর্তুকির জন্য প্রায় সমান বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রবন্ধের তথ্যে তা অসামঞ্জস্য করে দেখানো হয়েছে বলে তার পর্যবেক্ষণ।অধ্যাপক শামসুল বলেন, এভাবে বিদ্যুৎ, পাট, বিপিসি ও পিডিবির বরাদ্দ বিশ্লেষণেও সামঞ্জস্য নেই।তথ্য বিশ্লেষণে বস্তুনিষ্ঠতার এরকম অভাব হলে সিপিডি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে সিপিডির ভিজিটিং ফেলো কানিজ সিদ্দিক দেশি-বিদেশি আর্থিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে দেওয়া ভর্তুকির যথাযথ ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেন।অনুষ্ঠানের সঞ্চালক সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য ভর্তুকির সংজ্ঞা, দক্ষতা বৃদ্ধির জায়গা চিহ্নিত করা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পরামর্শ দেন।
ভর্তুকির ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টি সবার নজরে আনেন অধ্যাপক শামসুল আলম।কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরির জন্য ভর্তুকি দরকার। তবে ভর্তুকির জন্য নীতিমালা প্রয়োজন।প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশে আগে থেকেই ভর্তুকি আছে। ভর্তুকির প্রধান উদ্দেশ্য অসাম্য কমিয়ে আনা।২০১০ সালে যখন সরকার রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করেছিল, তখন জনগণের যে কোনো মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার আগ্রহ ছিল। এখন ভর্তুকি কমিয়ে আনতে সরকার দীর্ঘমেয়াদী কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে।অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যে লক্ষ্যে বাজেটে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা অর্জিত হচ্ছে কি না, তা গবেষণা করতে হবে। ভর্তুকিতে সংস্কার, উদ্দেশ্য ও স্বচ্ছতা দরকার।
সংলাপে অংশ নিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকারের প্রধান লক্ষ্য দরিদ্রতা ও অসাম্যতা কমানো। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।ভর্তুকির বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভর্তুকি খেয়ে খেয়ে বড় হয়েছে। এটি উঠিয়ে দেওয়া যাবে না। হঠাৎ করে উঠিয়ে দিলে রাজনৈতিক ও জনগণের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তবে এটি সঠিক স্থানে দেওয়া হচ্ছে কি না সেটি বিবেচনা করতে হবে। সঠিক ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেওয়া হলে তা বিনিয়োগ হিসেবে কাজ করে।কুইক রেন্টাল বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কুইক রেন্টাল পাওয়ার ওই সময় দরকার ছিলো। কারণ সে সময় বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো মূল্যে বিদ্যুৎ চেয়েছিলো।
মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ভর্তুকির সংজ্ঞায় স্বচ্ছতা আনা দরকার। কাকে ভর্তুকি বলবেন, কাকে বলবেন না সেটি নিরূপণ করতে হবে। বাজেটে ভর্তুকি ১৭ হাজার কোটি টাকা বলা হয়েছে। অথচ কেউ কেউ বলছেন ৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ভর্তুকির অঙ্কের হিসাবে গরমিল রয়েছে। তবে এটি অস্থিতিশীল নয়।সরকারের লোকসানি প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি বন্ধ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো উৎপাদন ব্যয় মেটাতে সক্ষম না। প্রতিবছর তাদের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যে খাত থেকে কোনোভাবেই মুনাফা আসছে না, সেই খাতগুলোতে ভর্তুকি বন্ধ করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া অথবা বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, যে লক্ষ্যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা অর্জিত হচ্ছে না। স্বচ্ছতা ও উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নের জন্য ভর্তুকির কিছু নীতিমালার ভিতরে আনা যেতে পারে।ড. দেবপ্রিয় বলেন, যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। দরিদ্র মানুষকে উদ্দেশ্য করে ভর্তুকি দেওয়া হলেও তা মূলত পাচ্ছেন ধনীরাই। বিপিসিএল’র মাধ্যমে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে তা পাচ্ছে বড় বড় কিছু কোম্পানি।তিনি আরও বলেন, কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের মতো দেশে ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে। এটি অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মতো কাজ করে। এজন্য স্বচ্ছভাবে সঠিক ক্ষেত্রে দিতে হবে। এখন সময় এসেছে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে একটি ‘জাতীয় ভর্তুকি নীতিমালা করা। যেহেতু বর্তমান অন্তর্জাতিক বাজারে সার ও তেলের দাম কম, চাপটাও কম। তাই সরকারের পক্ষে এখন নীতিমালা করাও সহজ হবে।