দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১ মে: রাজনীতির আকাশে আবারও কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে- এমনটাই ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণএবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে আশার আলো দেখতে শুরু করেছিলেন তারা। কিন্তু এ নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি, কমিশনের একচোখা নীতি এবং নির্বাচনের মাঝপথে বিএনপির ভোট বর্জনের ঘটনায় নিভু নিভু করছে সেই আশার আলো। আবারও সূচনা হতে পারে সহিংসতার রাজনীতির। দেশের রাজনৈতিক সংকটও আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে আশংকা বিশ্লেষকদের। কারচুপির অভিযোগ তুলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাঝপথে বর্জনের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। মঙ্গলবার তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলাকালে প্রার্থীর ওপর থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে নির্বাচন বর্জন করে তারা। যদিও দলের সমর্থিতদের নিয়ে গঠিত আদর্শ ঢাকা আন্দোলন সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বাতিল, পুনর্র্ন্বিাচন ও পুরো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পদত্যাগ দাবি করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানায়নি দলটি। নির্বাচনের পর চার দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত দলটির নেতারা পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও নিশ্চুপরয়েছেন। তবে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বিএনপি এখন কূটনৈতিক সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদের বছর পূর্তির দিন অর্থাৎ গত ৫ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচিদেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগের দিন গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে ওঠেন। একটানা ৩ মাস তিনিসেখানেই অবস্থান করেন। এ সময়ের মধ্যে অবরোধের পাশাপাশি হরতালও দেয় তারা। ২০ দলীয় জোটের টানা আন্দোলনে প্রাণহানিসহ বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়।এর মধ্যেই সরকার উদ্যোগ নেয় তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের। ১৮ মার্চ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। আওয়ামী লীগসহ অন্য দলগুলোর পাশাপাশি বিএনপিও এ নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী দেয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল, নির্বাচনের দিন থেকেই তা হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। সিটি নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করেছে বিএনপিনেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। যদিও এর প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত তারা আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি। বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়েবৈঠকের পর আন্দোলনে যাবেন তারা। তবে এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করতে নারাজ তারা। তাই আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সময় নিচ্ছে ২০ দলীয় জোট।
তবে বিশ্লেষকদের এসব আশংকা আমলে নিতে নারাজ শাসক দল দল আওয়ামী লীগ। তাদের মতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট প্রথম দিন থেকেই সরকার উৎখাতের আন্দোলন করছে। টানা ৩ মাস আন্দোলনের নামে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে।জনগণকে জিম্মি করে রাজনীতি করেছে। এতে সরকারের কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং জনমত উল্টো তাদের বিপক্ষে গেছে। যে কারণে তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেই সাধারণ মানুষ বিএনপি প্রার্থীদের বিপক্ষে রায় দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, বিএনপি এখন কাগুজে বাঘ। তাই তাদের হুমকি-ধমকিতে আওয়ামী লীগ ভয় পায় না। তিনি আরও বলেন, বিএনপির সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আসা এবং নির্বাচনের দিন সকালেই ভোট বর্জন পূর্বপরিকল্পিত’ এবং রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। তারা একটি ইস্যু তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। এতে কোনো লাভ হবে না। কারণ বিএনপির সঙ্গে দেশের মানুষ নেই।
এ মতের বিপরীতে বিএনপি বলছে অন্য কথা। তাদের মতে, বিএনপি প্রথম থেকেই বলে আসছে আওয়ামী লীগের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যে কারণে তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই বিএনপি তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়। এ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি জনগণ স্বচক্ষে দেখেছে। যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি ছিল যৌক্তিক। এ প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ বলেন, সরকারের শত দমন-পীড়ন সত্ত্বেও তারা তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার যে আচরণ করেছে, তাতে প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ আরও বলেন, এবার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দেখার পর জনগণও বুঝতে পেরেছে বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামের যৌক্তিকতাও প্রমাণিত হয়েছে। জনগণের রায় প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদেরই পতন ত্বরান্বিত করেছে। তিনি বলেন, এত বড় ভোট ডাকাতির পর নিশ্চয়ই তারা ঘরে বসে থাকবেন না। শিগরিই মাঠে নামবেন। তিন সিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতিসহ সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে রাজপথে নামবেন তারা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ আরও বলেন, দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কর্মসূচি নির্ধারণ করবেন। তারা আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। হুটহাট কর্মসূচিও দেবেন না। এবার অনেক ভেবেচিন্তে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামবেন।
দুই প্রধান দল ও জোটের এ মুখোমুখি অবস্থান রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত বলে মন্তব্য করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনীতিতে এক ধরনের সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন নিয়ে যা ঘটল তা কারও কাছেই কাক্সিক্ষত ছিল না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের ফল নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি বেলা গড়াবার আগেই বিএনপির নির্বাচন বর্জন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। একইভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, ভোটের রাজনীতি আবার মাঠে গড়াবে। হয়তো আবারও সংঘাত-সহিংসতার সংস্কৃতি ফিরে আসবে। এমনটি হলে তা সত্যিই আমাদের সবার জন্য দুঃখজনক হবে।সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে টানা ৩ মাস সংঘাত-সহিংসতার মধ্যে ডুবে ছিল দেশ। সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিল। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ঘোষণা এবং এই নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে মনে হয়েছিল গণতন্ত্র যেভাবে লাইনচ্যুত হয়ে পড়েছে, তা বুঝি আবার লাইনে আসছে। নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যেভাবে সব দল মিলে নির্বাচন করেছে, একসঙ্গে গলাগলি করেছেন, তাতে আমরা একটা সুস্থ ধারায় ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে এ নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। তিনি আরও বলেন, তিন সিটিতেই নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তা সত্যিই অনভিপ্রেত। এরকমটা কারও কাছেই কাম্য ছিল না। সংঘাত-সহিংসতার আশংকা দেখা দেবে। যা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। সবাইকে এর জন্য খেসারত দিতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বলতে মানুষ যেটি মনে করতেন, সেটি হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু সেই নির্বাচন তো আর হল না। এবারের তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল দেশে আর গণতন্ত্র থাকল না। ২০১৪ সাল থেকে দেশে আর নির্বাচন নেই। সব চলছে গায়ের জোরে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা জাতীয় জীবন ও রাজনীতিতে অবশ্যই বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তবে কীভাবে ফেলবে, কতটুকু ফেলবে- তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ও পেশিশক্তির প্রয়োগে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হওয়ায় তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠান তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ব্যাপক কারচুপির নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ থাকার পরেও কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অস্বীকৃতি, মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বিব্রত করেছে। এ ঘটনার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নতুন করে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনীতি থেকে উত্তরণের যে ইতিবাচক সুযোগের সৃষ্টি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়েছে।সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়ম রাজনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত। তিনি বলেন, মানুষ তার রাগ এবং ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নির্বাচনে ভোট দিয়ে। তা যদি ব্যাহত হয় তাহলে সে অনিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে শুরু করে। ভোটের লড়াই রাজপথে গিয়ে পেশিশক্তির লড়াইয়ে পরিণত হয়। রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে একটি সমাধানে আসার চেষ্টা চলে। আর এ েেচষ্টা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তাহলেই গণতন্ত্র ব্যহত হয়। এ বিষয়টি সব পক্ষকে বুঝতে হবে। না বুঝলে বিপদ আসন্ন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনেক আশা, সংশয় ও অনিশ্চয়তা নিয়েই তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। মানুষ আশা করেছিল, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কারণে বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতিতে যে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে, তা অব্যাহত থাকবে। অনেকে এটাও আশা করেছিলেন, একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ আশায় গুড়ে বালি হয়েছে। রাজনীতি বোধ হয় আবারও সেই পুরনো পথেই হাঁটতে শুরু করবে।বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের নজিরবিহীন ভোট ডাকাতি রাজনীতিকে আরও গভীরতম অন্ধকারে নিমজ্জিত করবে। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও নৈরাজ্য বাড়বে। যা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
ঐক্য ন্যাপের সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনের নামে যা ঘটে গেল তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে রাজনীতিসহ সামগ্রিক জনজীবনে। তিনি বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা সুষ্ঠু না হলে পরিণতি ভয়ংকর হয়। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন বর্জনের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ। একইভাবে নির্বাচন কমিশনও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, এখন ভোটের রাজনীতি মাঠে গড়াবে। এক দল সরকার হঠাতে শক্তি প্রদর্শন করবে। আর যারা ক্ষমতায় আছে তারাও টিকে থাকতে শক্তি প্রদর্শন করবে। ফলে রক্তপাত, সংঘাত-সহিংসতা বাড়বে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যা ঘটেছে, যা পড়েছি, দেখেছি, উপলব্ধি করেছি তাতে এটা পরিষ্কার যে, নির্বাচন নিয়ে যা ঘটেছে তা মোটেও ভালো হয়নি। এর প্রভাব জাতীয় জীবনে, রাজনীতিতে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় পড়বে। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনের পর পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজনীতি ভঙ্গুর অবস্থানে চলে গেছে। এর পরিণাম মোটেও শুভ হবে না।সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, আমরা একটা খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। একটা খারাপ অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করেছি। তিন সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা এক ধরনের ‘ম্যানেজড’ নির্বাচনের যুগে প্রবেশ করেছি। ভবিষ্যতে যত নির্বাচন হবে এ ধরনের ‘ম্যানেজড’ নির্বাচনই হবে। জনগণও এই ‘ম্যানেজড’ নির্বাচনেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা ২০১০ সালের পর নতুন ভোটার হয়েছে তাদের কাছে এ ধরনের নির্বাচন তো স্বাভাবিক মনে হবে। কারণ তারা তো এর আগের ভালো নির্বাচন দেখেনি। তিনি বলেন, এটা দেশের জন্য নিঃসন্দেহে ভালো নয়। এতে করে রাজনৈতিক সংকট আরও বেড়ে গেল।
সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য সরকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি নাটক খেলেছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে এ দেশে ভবিষ্যতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না- তা আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, এ নির্বাচন নিয়ে আর কী বলব। কী হয়েছে তা তো সবার কাছেই পরিষ্কার। তিনি বলেন, এ ঘটনার বিরূপ প্রভাব ফেলবে রাজনীতিতে। জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে যে সংকট ছিল তা আরও ঘনীভূত হবে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংগঠন জানিপপের প্রধান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, নির্বাচনে সরকারি দল যা করেছে তা সত্যিই অনাকাক্সিক্ষত। অন্যদিকে মাঝপথে বিএনপির নির্বাচন বর্জন সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। তিনি বলেন, নির্বাচনে কারচুপি কিংবা নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী নয়, বরং দুর্বল করে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, কী কর্মসূচি দেয়া হবে, তা নিয়ে শীর্ষ নেতারা বিভক্ত। একটি অংশ নির্বাচনের দিনই কর্মসূচি দেয়ার পক্ষে ছিলেন। আরেকটি অংশ বলছেন, পর্যালোচনা করেই কর্মসূচি দেয়া উচিত। কারণ কর্মসূচি দিলেই তো হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। তারা বলছেন, যেহেতু সরকারের সঙ্গে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছেন কূটনীতিকরা, কাজেই তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি চূড়ান্ত করা যেতে পারে।কূটনৈতিক সূত্র জানায়, পরিস্থিতি যাতে কোনোভাবেই সংঘাতপূর্ণ অবস্থায় ফিরে না যায়, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে সহিংসতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে, তা কূটনীতিকদের সঙ্গে বসার পরই ঠিক করা হবে। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, নিশ্চয়ই কর্মসূচি দেয়া হবে। কীভাবে দলকে সংগঠিত করে কর্মসূচি দেয়া যায়, সে বিষয় নিয়ে এখন পর্যালোচনা চলছে। নতুন কর্মসূচি দিলেই তো হবে না, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য কিছুদিন সময় নেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, একটি সমঝোতা’র ভিত্তিতেই খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে ৩ মাস পর বাসায় ফিরে যান। ওই সমঝোতার কারণেই বিএনপি নির্বাচনে গিয়েছিল। বিএনপি এ আশ্বাসও পেয়েছিল যে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। কিন্তু দলটির অভিযোগ, শাসক দল আওয়ামী লীগ ভোট ডাকাতি করে ফল নিজেদের ঘরে নিয়ে গেছে। এ কারণে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। বিষয়টি কূটনীতিকরাও উপলব্ধি করেছে। ওই সমঝোতায় মধ্যস্থতা করেছিলেন ঢাকায় কর্মরত কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা। এ কারণেই নির্বাচনপরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে কূটনীতিকদের দিকে তাকিয়ে আছে বিএনপি।
জানা যায়, ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের সঙ্গে বিএনপি চয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বৈঠক হতে পারে। বৈঠকে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাটওউপস্থিত থাকবেন।এ বিষয়ে চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বৈঠকের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।হলে মিডিয়াকে জানানো হবে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমেদ আযম খান বলেন, মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ে এ সরকারকে আন্দোলনের মাধ্যমে বিদায় করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে বিএনপি জানুয়ারি মাস থেকে একটা লম্বা আন্দোলন করেছে। তাই হঠাৎ করে নতুন কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার আগে এবার ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা হবে। জোটের শরিকদের সঙ্গে কথা বলা হবে। কথা বলা হবে সুশীল সমাজের সঙ্গেও। তিনি বলেন, বিএনপি সাধারণ মানুষ এবং বিদেশি বন্ধুদের প্রতিক্রিয়াও দেখতে চায়। দেখতে চায় তারা এ নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন। খালেদা জিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই এসব বিষয় নিয়ে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বসবেন।নির্বাচন বর্জনের পর সবাই শঙ্কিত হয়েছিল যে, দেশ নতুন করে সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে কিনা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকগণমাধ্যমেও বিষয়টি জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে।নির্বাচনের দিন দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে বর্জন করার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থা ‘হতাশা’ ব্যক্ত করে ভোট বর্জনের ফল যাতে সহিংসতায় না গড়ায়, সে আহ্বান জানিয়েছিল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) বলেছে, ভোট জালিয়াতির নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন তাদের কাছে আছে। ফলে এসব অনিয়মের দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চেয়েছে তারা। জাতিসংঘ, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডাও সিটি নির্বাচনে অনিয়মের দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চেয়েছে।
এদিকে নির্বাচনের দিন কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেন্স ব্লুম বার্নিকাট নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে লেখেন, যে কোনো মূল্যে জিততে চাওয়া আসলে কোনো জয়ই নয়। আরেকটা টুইটে তিনি বলেন, বাংলাদেশের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকেই বিএনপির সরে যাওয়ায় আমি হতাশ। বার্নিকাট এ নির্বাচন নিয়ে প্রথম টুইট করেছেন নির্বাচনের আগের দিন সোমবার। সেখানে তিনি লেখেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন একটি স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। আশা করি আগামীকালের নির্বাচন সে চেতনারই উদাহরণ হয়ে থাকবে। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই তার আশা হতাশায় রূপ নেয়। বিকাল ৫টার দিকে দূতাবাসের ফেসবুক পেজে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, ভোট কেন্দ্রে ব্যাপক ও সরাসরি অনিয়ম এবং হুমকি ও সহিংসতার ঘটনায় আমরা খুবই হতাশ। বিএনপি সিটি নির্বাচন বয়কট করাতেও আমরা হতাশ। নির্বাচনের অনিয়মের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন আমাদের কাছে আছে। স্বচ্ছতা ও পক্ষপাতহীনভাবে অনিয়মের তদন্ত হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব রাজনৈতিক দলকে আইনের মধ্যে থাকতে যে কোনো মূল্যে সহিংসতা পরিহার করতে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। রাজনৈতিক উদ্দেশে যে কোনো ধরনের সহিংসতাকে আমরা তীব্রভাবে নিন্দা জানাই।
হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসনও। এর পর একে একে নির্বাচনে অনিয়মের তদন্ত চেয়েছে জাতিসংঘ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইইউ। পাশাপাশি সহিংসতা যাতে আবার না ছড়িয়ে পড়ে, সেজন্যও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সব রাজনৈতিক দলকে আইনের মধ্যে থাকতে যে কোনো মূল্যে সহিংসতা পরিহার করতে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি। রাজনৈতিক উদ্দেশে যে কোনো ধরনের সহিংসতাকে আমরা তীব্রভাবে নিন্দা জানাই। যুক্তরাজ্য তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, নির্বাচনের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে রাতে এবং আগামী কয়েক দিন সংহিসতা বা বিঘ্ন সৃষ্টিকারী কোনো ঘটনা ঘটবে না বলে আমরা আশা করি। সব রাজনৈতিক দলের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন। অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা আইনের মধ্যে থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিক্রিয়া দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করতে চায়, যেখানে আইনের শাসন ও মানবাধিকার বিদ্যমান।