দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৬ এপ্রিলঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে সমঝোতার পথে আসার আহবান জানিয়েছেন খালেদা জিয়া।রোববার বিকালে গুলশানে নিজের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ ক্ষমতায় বসতে ও বসার পর আপনি অনেক অপরাধ-অপকর্ম অকৌশল করেছেন। এখন রাষ্ট্রক্ষমতা আপনার কাছে। বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছে। আপনি নামতে ভয় পাচ্ছেন। আপনি ভয় পাবেন না। আমরা বলতে চাই, আপনার মতো প্রতিশোধপ্রবন নই। আপনি নম্র, ভদ্র, সংযমী হউন। উগ্র স্বভাব ও জিঘাংসার মনোবৃত্তি বদলান। গণতন্ত্র ও সংলাপের পথে আসুন। আমরা সহি সালামে নিরাপদে নামতে সাহায্য করবো। একই সমতলে দাঁড়িয়ে নির্বাচন করবো। মানুষ যাকে খুশি বেঁছে নেবে। আসুন সেই পথটা অন্তত খুলে দেই।’’
দুপুর দুইটার দিকে গুলশান কার্যালযের নিচতলায় ব্রিফিং কক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। লিখিত বক্তব্য দেয়ার পর সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নেরও জবাব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে গত ৩ জানুয়ারি থেকে একটানা ৯২ দিন গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান শেষে গত ৫ এপ্রিল নিজের বাসা ফেরার পর এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন বেগম জিয়া। তিনমাস কার্যালয়ে অবস্থানের মধ্যে গত ১৩ মার্চ সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিনি।দুপুর ২টায় গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে কার্যালয়ে এসে পৌঁছনোর সময়ে গেইটের সামনে নেতা-কর্মীরা বেগম জিয়াকে করতালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। খালেদার পৌনে ৫০ মিনিটের বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের দমন-পীড়ন, আসন্ন সিটি নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব ভুমিকা, নির্বাচনের প্রচারণা ক্ষমতাসীনদের হামলা প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে।
ঢাকা সিটি নির্বাচনে প্রচারনার সময়ে ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র কর্মীদের হামলার ঘটনা তুলে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘‘ প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে আমার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন, তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সশন্ত্র সন্ত্রাসীদের আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছেন।তারা প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষের সামনে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে উত্তরা, কারওয়ান বাজার, ফকিরেরপুলের কাছে ও বাংলা মোটবের আমার গাড়িবহরে পরপর চারদিন হামলা করেছে। বাংলা মোটরে আমাকে বহনকারী গাড়ির ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হয়। আমার গাড়িটি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।হামলায় ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেয়। হামলাকারীদের পুলিশ পুরোপুরি সহযোগিতা করে। সবচেয়ে মারাত্মক হামলার ঘটনা ঘটেছে কাওয়ানবাজারে। সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে হামলা চালায়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। আমি যে আসনে বসেছিলাম, সেই আসনের পাশেই বুলেট প্রুফ গাড়ির জানালার কাঁচে গুলি লেগে ফেটে যায়। আল্লাহর রহমতে অল্পের জন্য আমার জীবন রক্ষা পায়।’’
কারওয়ান বাজারসহ সব হামলার ঘটনাকে সুপরিকল্পিত অভিহিত করে খালেদা জিয়া বলেন,‘‘ এটা যে আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য পরিচালিত সুপরিকল্পিত হামলা ছিলো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি হামলার ঘটনাই প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের সরাসরি উস্কানি ফল এবং সুপরিল্পিত। ওইসব হামলায় পুলিশ নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করে।’’এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘‘ আমার প্রাণনাশের লক্ষ্যে দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলার পর প্রধানমন্ত্রী ওইসব ঘটনাকে যেভাবে নাটক আখ্যা দিয়েছেন এবং স্বরাষ্ট্র প্রতি মন্ত্রী যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত। আমি বুঝতে পারছি, এর কোনো বিচার হবে না। সন্ত্রাসীরা ক্ষমতার খুঁটির জোরে ও আশকারা পেয়ে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।’’
‘‘ এতে আমি ভয় পাই না। জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামিন। তিনি রক্ষা করলে আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না।আমি একথাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ একদিন এই অন্যায় –অবিচারের এই সন্ত্রাস, এই মিথ্যাচার ও এই হত্যাচেষ্টা ন্যায্য বিচার করবেন।’’বক্তব্যের এক পর্যায়ে আবেক আপ্লত কন্ঠে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ আমার প্রিয় দেশবাসী, বিশেষ করে ঢাকা বাসীকে বলব, আপনারা দেখেছে, ক্ষমতার দম্ভে আমার সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করা হচ্ছে। আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশকে ভালোবেসে ও জনগনের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। অল্প কিছুদিন আগে আমি আমার আদুরের ছোট ছেলেটিকে চিরকালের জন্য হারিয়েছি।’’‘‘ আমরা একমাত্র জীবিত সন্তানটি অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দূরে দেশে চিকিৎসাধীন রয়েছে। জীবনের এই প্রান্তে এসে প্রিয় মাতৃভুমিতে স্বজনহীন পরিবেশে চরম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এখনো আমি জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমত সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এখন আপনারাই আমার স্বজন, আপনারাই আমার আত্বীয়। আমার সব তৎপরতা আপনাদেরকেই ঘিরে।’’ এ সময়ে খালেদা জিয়া নিজের চমশা খুলে টিসু দিয়ে চোখ মুছতে দেখা যায়।
সেজন্য সব ‘অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিকার ও উপযুক্ত জবাব’ দেয়ার জন্য ঢাকাবাসীর প্রতি আহবানও জানান খালেদা জিয়া।নির্বাচনী প্রচারনায় হামলায় ঘটনার দেশবাসী বিশেষ করে বিদেশী দেশসমূহের উদ্বেগ-সহমর্মিতা প্রকাশের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা করে তিনি বলেন, ‘‘ ধারাবাহিক ওইসব হামলা ও নির্বাচনী প্রচারকাজে বাঁধা দেয়ার বিরুদ্ধে পক্ষপাত দুষ্ট নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়া দূরে থাকুক, টু-শব্দ পর্য্ন্ত করেনি।’’সংবাদ সম্মেলনে অন্যানের মধ্যে আর্দশ ঢাকা আন্দোলনের আহবায়ক অধ্যাপক এমাজউদ্দিীন আহমেদ, সদস্য সচিব শওকত মাহমুদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ, সদস্য মাহফজুউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।
২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে খেলাফত মজলিশের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাক, জামায়াতে ইসলামীর ডা. রিদওয়ান উল্লাহ শাহিদী, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ নেজামী, জাগপার শফিউল আলম প্রধান, এলডিপি‘র রেদোয়ান আহমেদ, লেবার পার্টির মুম্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামিক পার্টির আবদুল মোবিন, এনপিপি‘র ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ন্যাপের জেবেল রহমান গনি, এনডিপি‘র খন্দকার গোলাম মূর্তজা, পিপলস লীগের সৈয়দ মাহবুব হোসেন, জমিয়তে উলাম ইসলামের মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, ডিল‘র সাইফুদ্দিন মনি প্রমূখ ছিলেন।সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, আসম হান্নান শাহ, জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান,বিশেষ সহকারি শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।