দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২৪ এপ্রিল: ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশন চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, রিজার্ভ নয়, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখা উচিত। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা যাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন- সেই আইনি ক্ষমতাও তাদের দিতে হবে।বিশিষ্টজনদের মতে, তা না হলে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। নির্বাচনকে ঘিরে চলতে থাকা সহিংসতা আরও বাড়বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোটারদের ওপর। তাদের মনে ভর করবে ভয়ভীতি এবং আতংক। এতে ভোট কেন্দ্রে সাধারণ ও নিরীহ ভোটার, বিশেষ করে নারী ভোটারদের উপস্থিতি কম হতে পারে বলে শঙ্কা বিশিষ্টজনদের।ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন প্রভাব বিস্তার,কেন্দ্র দখলে রাখা বা কেন্দ্রে আশেপাশে প্রভাববলয় তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন কোনো কোনো প্রার্থী। এতে রক্তপাতের আশঙ্কা করছ্নে ভোটাররা।
এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা দলীয় প্রভাব এবং দলীয় কর্মীদের ব্যবহার করে ভোটারদের উপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।নগরীর বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যে এসব খবর জানা গেছে।বিশেষ করে গত কয়েকদিন নির্বাচনী প্রচারণায় নামা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে পরপর তিন দফা হামলার পর এমন আশঙ্কা আরো বদ্ধমূল হয়েছে মানুষের মনে। কারণ এসব হামলায় বারবার ছাত্রলীগ-যুবলীগের নামই উঠে এসেছে।এরইমধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে মূলত ক্ষমতাসীনদের দুই গ্র“প ও আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। শুধু তাই নয় এসব সহিংসতায় পেশাদার সন্ত্রাসী ও খুনীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগে উঠেছে।
জানা গেছে,প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীরা শুধুমাত্র একে অপরের উপর হামলার মধ্যেই নিজেদের এখন আর সীমাবদ্ধ রাখছেন না। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে জানে মেরে ফেলতে ভাড়া করা হচ্ছে পেশাদার খুনী। এরকমই একটি চক্রকে সম্প্রতি অস্ত্রসহ আটক করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।গত মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি ও কতোয়ালি থানা এলাকা থেকে আটক করা হয় পুরান ঢাকার ডাকাত সর্দার হিসেবে পরিচিত সাগর, দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন, চাঁন মিয়া ও আল আমিনকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র ও গুলি। তারা পুলিশকে জানিয়েছে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের।এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, নির্বাচনকে সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা ও দাম দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। আটককৃতরা স্বীকার করেছে তারা দুইজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে হত্যা করতে চেয়েছিল।তাদের এসব তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।অন্যদিকে নির্বাচনের দিন কোনো প্রার্থী কেন্দ্র দখল আবার কোনো প্রার্থী কেন্দ্র পাহারা দিয়ে আশেপাশে প্রভাববলয় ৗৈতরির জন্যও ভাড়াতে সন্ত্রাসীদের নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করছে বলেও খবর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। এজন্য আগাম প্রস্তুতি সেরে রাখছেন অনেকে।
সূত্র জানিয়েছে, পুরান ঢাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত একজন কাউন্সিলর প্রার্থী কয়েকটি কেন্দ্র দখলে রাখতে ধানমণ্ডি এলাকা থেকে এরকমই কিছু মাস্তান ভাড়া করে ফেলেছেন। আবার ওই ওয়ার্ডেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী কেন্দ্র পাহারা দেয়ার জন্য ঠিক করে রেখেছেন ভাড়াটে লোক।সূত্র জানায়, কেন্দ্র দখল বা পাহারায় প্রয়োজনে রক্তপাতের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন ওইসব প্রার্থী।
কেন্দ্র দখল বা পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত কর্মী বা ভাড়াটে লোকদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় প্রতিশ্র“তিও দিয়ে রাখছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। যেমন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে ছাড়িয়ে আনার নিশ্চয়তা, এলাকা ছাড়া হয়ে ২/৩ বছরের জন্য পলাতক থাকতে হলে থাকা-খাওয়ার গ্যারান্টি, সেইসঙ্গে নগদ অর্থের প্রলোভনতো থাকছেই।গত কয়েকদিনে রাজধানীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে তার মাত্রাও বাড়তে শুরু করেছে।
বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী খাজা হাবিবুল্লাহ হাবিবের গাড়িতে আগুন, নির্বাচনী ক্যাম্প ও বাসায় ভাঙচুর করা হয়। খাজা হাবিবুল্লাহ অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা এসব তাণ্ডব চালিয়েছে।এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী রয়েছেন অ্যাডভোকেট এমএ হামিদ খান এবং আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয়সহ-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,বাংলামোটরেবিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনার পরপর এই হামলার ঘটনা ঘটে।
বুধবারে অপর একটি ঘটনায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের (সূত্রাপুর-নবাবপুর) কাউন্সিলর প্রার্থী জাকির হোসেনের নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর চালানো হয়। জাকির হোসেন জানান, তার প্রতিদ্বন্দ্বী ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী আবু আহমেদ মান্নাফ দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে ৭৯/৮০ নম্বর নবাবপুর রোডের নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় তিনি সূত্রাপুর থানায় একটি অভিযোগ করেছেন।জানা গেছে, আবু আহমেদ মান্নাফ সূত্রাপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
অন্যদিকে জাকির হোসেন স্থানীয় মহল্লা কমিটির সাধারণ সম্পাদক।বুধবার রাত ১০টার দিকে লালবাগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাঊন্সিলর প্রার্থী মোশাররফ হোসেনের (বি কম) বাসা লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায় হাজি সেলিম সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকরা।একই দিনে লালবাগের নবাবগঞ্জে সুজন আয়োজিত নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে মারামারির ঘটনায় আহত হন সাবেক কমিশনার হুমায়ুন কবির এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আল আমিন।
এর আগে মঙ্গলবার রাত ১টার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী মো. আফসার উদ্দিনের বাসায় গুলিবর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। খিলগাঁও ভূইয়াপাড়ার ২৪০/এ নম্বরের বাসার সামনে এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ৮টি গুলির খোসা উদ্ধার করেছে। তিন সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে উল্লিখিত মন্তব্য করেন দেশের চার বিশিষ্টজন। তারা হলেন- প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী।ব্যারিস্টার রফিক উল হক বলেন, রিজার্ভ নয়, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীর সদস্যরা যাতে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে- সেই ক্ষমতাও তাদের দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সেনবাহিনীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে লাভ হবে না। তাদের কাজে লাগাতে হবে। তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দিতে হবে।
বর্ষীয়ান এই আইনজীবী বলেন, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামালে সন্ত্রাসী ও গডফাদাররা যে দলেরই হোক কাপড় খুলে পালাবে। ভয়ে সবাই ঠিক হয়ে যাবে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা বলে- শুধু র্যাব আর পুলিশ দিয়ে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করা সম্ভব নয়।নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনকেসেনাবাহিনীকে কাজে লাগাতে হবে।বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং তার গাড়িবহরে হামলা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচনের এখনও অনেক দিন বাকি। এখনই হামলা শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের দিন যে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না- তার নিশ্চয়তা কে দেবে? নির্বাচন কমিশনকেই এর নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা দিতে না পারলে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে না। মানুষ ভয়ে-আতংকে ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে ঘরে বসে থাকবে।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে ততই জনমনে নানা আশংকা জেঁকে বসেছে।বিশেষ করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে পরপর তিন দিন হামলার ঘটনায় অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ নিয়ে মানুষের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় নির্বাচনের দিন র্যাব ও পুলিশসহ বিপুলসংখ্যক আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হবে।তারা সেনাবাহিনীকেও রিজার্ভ রাখার কথা বলেছে। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখনই তো নানা জায়গায় সংঘাত, সহিংসতা শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তারা কি করছে বা কি করবে- তা তারাই ভালো বলতে পারবে। সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, নির্বাচন কমিশনকে মানুষের মন থেকে আতংক ও ভয়ভীতি দূর করতে হবে। মানুষের মনে আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। এই দায়িত্ব তাদের, আর কারও নয়। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীকে ডাকা হল, তারা রাস্তায় দাঁড়িয়েও থাকল- তাতে লাভ হবে না।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা যাতে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন সে ব্যবস্থাও নিতে হবে।সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমার তো মনে হয় সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশন চতুরতার আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলছে, নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী ক্যান্টনমেন্টে রিজার্ভ হিসেবে থাকবে। রিটার্নিং অফিসার ডাকলে তারা ছুটে আসবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী তো ক্যান্টনমেন্টেই থাকে, তারা তো আর বাইরে থাকে না। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন চতুরতার আশ্রয় নিল। পুরো বিষয়টিই লোক দেখানো।ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের সময় মাঠে রাখতে হবে। তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দিতে হবে। তা না হলে কোনো লাভ হবে না। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনের সময় মাঠে সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা না থাকায় ওই নির্বাচনের সময় ব্যাপকভাবে সংঘাত-সহিংতার ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও ঘটুক তা আমরা চাই না। যদিও খালেদা জিয়ার এবং তার গাড়িবহরে পরপর তিন দিন হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে সেই আলামত দেখা দিয়েছে।
সুজন সম্পাদক আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার দায়িত্ব সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। ভোটারদের নিরাপত্তা দেয়াসহ নির্বাচনে যাতে সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং প্রাণহানির ঘটনা না ঘটে তা দেখার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় সাধারণ ভোটাররা সন্তুষ্ট নন। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ভয়ভীতিসহ নানা ধরনের আশংকা জনমনে জেঁকে বসেছে।তিনি বলেন, এখনও সময় আছে- নির্বাচন কমিশনকে এ আশংকা দূর করতে হবে। তা না হলে সাধারণ ভোটার, বিশেষ করে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ভোট কেন্দ্রে কম দেখা যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দেশের মানুষ এমনিতেই উদ্বিগ্ন।এর মধ্যে আবার তিন সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনকে ঘিরে কি হয় তা নিয়েও দেশের মানুষ গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে নারী ভোটাররা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তারা নিরাপদে ভোট দিতে কেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা, ভোট দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা- এ প্রশ্ন সবার।তিনি বলেন, নারী ভোটারসহ সব ভোটারের সামগ্রিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার কাজটি নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু তারা এক্ষেত্রে কতটা সফল হবেন- এ নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জমেছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে তারা অহেতুক বিতর্ক এবং ধূম্রজালের সৃষ্টি করেছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেনা সদস্যদের ডেকে কি হবে? রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র চিহ্নিত করেছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে পরবর্তীকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার দায়ভার তাদেরই নিতে হবে।মঙ্গলবার প্রেস ব্রিফিং করে পট্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ জানান, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সেনা সদস্যরা ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত স্ট্রাইকিং ও রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন। এ সময় কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের মানসিক স্বস্তির জন্য সেনা মোতায়েন করা হচ্ছে।প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) এই আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এর পরপরই কমিশন সচিবালয় থেকে সেনা মোতায়েনের চাহিদা জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব শামসুল আলমের স্বাক্ষর করা এই চিঠিতে প্রতিটি সিটি কর্পোরেশনে এক ব্যাটালিয়ন করে সেনা সদস্য মোতায়েন করতে বলা হয়।
কিন্তু পরদিনই অর্থাৎ বুধবার সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে মত পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশন। এদিন সশস্ত্র বিভাগকে সংশোধিত চিঠি দেয় তারা। এই চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচনে সেনাবাহিনী আগামী ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনানিবাসের (ক্যান্টনমেন্ট) অভ্যন্তরে অবস্থান করবে। কেবল রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে তারা। এই চিঠিটি মঙ্গলবার পাঠানো চিঠির স্থলাভিষিক্ত হবে বলে উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশন।সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ ও ১৩০ ধারা অনুযায়ী কমিশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। সংবিধানে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের কাজে সহায়তা করা রাষ্ট্রের সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো গোলযোগ দেখা দিলে তা ছত্রভঙ্গ করার জন্য দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট সেনাবাহিনী তলব করতে পারবেন। তখন সেনা সদস্যরা গোলযোগকারীদের শাস্তি দেয়ার জন্য আটক করতে পারবেন।নির্বাচন কমিশনের সংশোধিত চিঠি অনুযায়ী প্রতিটি সিটি নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সদস্য রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনানিবাসে (ক্যান্টনমেন্টে) অবস্থান করবেন। নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে টওস্তুতও থাকবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা অনুরোধ করলে তারা বাইরে আসবেন। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে দেখা যাবে না সেনাবাহিনীকে।
তিন সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন টওশ্ন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একজন কমিশনার সীমিত পরিসরে সেনা মোতায়েনের নোট দিয়েছিলেন। অন্য দু’জন কমিশনার তাতে সায় দেন। এ কারণেই মূলত নির্বাচনী কার্যক্রমে সেনাবাহিনীকে পরোক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপরই সেনাবাহিনী চেয়ে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে দেয়া ইসির চিঠি সংশোধন করে পুনরায় পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।বুধবার দ্বিতীয় দফায় পাঠানো ইসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয় প্রতি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এক ব্যাটালিয়ন করে সেনাবাহিনীর সদস্য আগামী ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল চার দিন দায়িত্ব পালন করবেন। তারা মূলত সেনানিবাসের অভ্যন্তরেই রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে অবস্থান করবেন এবং রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন।’ অথচ একদিন আগে মঙ্গলবার পাঠানো চিঠিতে ওই অংশে বলা হয়েছিল,সেনাবাহিনী মূলত স্ট্রাইকিং েেফার্স এবং রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। রিটার্নিং অফিসার ডাকলেই তারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন।’ পরের চিঠিতে সেনা সদস্যদের ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।ক্যান্টনমেন্টকে ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে ওই স্থান থেকে সবদিকে সহজেই যাওয়া যায়- এমন বিবেচনায় সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ। তিনি বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনকালীন সেনাবাহিনীর জন্য ‘বেস্ট পজিশন’ ক্যান্টনমেন্ট (সেনানিবাস)। সেনা মোতায়েনে প্রথম চিঠিতে ভুল-ত্র“টি হয়ে থাকতে পারে উল্লেখ করে পরে আগের চিঠিটি সংশোধিত আকারে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।আর নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ জানিয়েছেন, ইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী চিঠি দেয়া হয়েছে। ‘সেনাবাহিনী কোথায় থাকবে, ওই (মঙ্গলবার পাঠানো চিঠি) চিঠিতে উল্লেখ ছিল না। যেহেতু নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট রয়েছে। যে জন্য সেনাবাহিনীকে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করার জন্য বলেছি। তারা সেখানেই টওস্তুত থাকবে। তাদের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটও থাকবেন। রিটার্নিং অফিসারের দরকার হলে তাদের কাজে লাগাবেন। সেনা সদস্যরা নির্বাচনে টহল দেবেন না বলেও জানান তিনি।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগের নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং ও রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে মোতায়েন করা হয়। এবারই প্রথম ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সেনা সদস্যদের আবদ্ধ রাখা হল। সেনা সদস্যরা মাঠে না থাকায় ভোটারদের মধ্যে আতংক থেকে যাবে বলেও মনে করছেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যে প্রক্রিয়ায় পুনরায় চিঠি তৈরি ও পাঠানো হয়েছে তাতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, সেনা মোতায়েন না করার বিষয়ে ইসির ওপর এক ধরনের চাপ ছিল। বুধবার সন্ধ্যায় ইসির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী হাতে হাতে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে চিঠিটি পৌঁছে দেন।যদিও কোনো মহলের চাপে দ্বিতীয় দফা চিঠি পাঠানো হয়নি বলে দাবি করেছেন নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ। বৃহস্পতিবার বিকালে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, কোনো চাপে আমার বিন্দুমাত্র পিছিয়ে যাইনি। সেনাবাহিনী নিয়োগে যে চিঠি দেয়া হয়েছে তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু সেনাবাহিনীর অবস্থান কোথায় হবে- তা সুনির্দিষ্ট করেছি। যাতে সবাই জানতে পারেন- সেনাবাহিনী কোথায় রয়েছে, কিভাবে রয়েছে, কিভাবে তারা বের হবেন।
রাতে কমিশন সচিবালয় ত্যাগ প্রাক্কালে সিইসি বলেন, সেনাবাহিনী সবসময় রিজার্ভ ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকে। এবারের নির্বাচনেও তাই থাকবে। তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট হল ঢাকা সিটির কেন্দ্রবিন্দু। মিরপুরে যেতে গেলেও ক্যান্টনমেন্ট বেটার, উত্তরায় যেতে গেলেও ক্যান্টনমেন্ট বেটার। সেনা সদস্যদের তো এক জায়গায় থাকতে হবে? আমরা মনে করেছি, ক্যান্টনমেন্ট তাদের জন্য বেস্ট পজিশন। তবে তাদের ডাকা হলেই তারা মুভ করবে। তিনি বলেন, কৌশলগতভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুভ করাটা সেনাবাহিনীর জন্য সহজ হবে। রিটার্নিং অফিসাররা ডাকা মাত্রই তারা চলে আসবে। ম্যাজিস্ট্রেটও তাদের সঙ্গে থাকবে।’ তাই কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন তিনি।এদিকে নির্বাচনে সেনা সদস্যদের টহল দেয়ার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে মো. শাহনেওয়াজ আরও বলেন, আমি আগেও বলেছি, আজকেও বলছি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যসহ র্যাব, বিজিবি, আনসার টহল ও অবস্থান নেবে। সেনাবাহিনীকে স্ট্রাইকিং রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রেখেছি, যখনই প্রয়োজন হবে রিটার্নিং অফিসারা বলার সঙ্গে সঙ্গে মুভ করবে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু প্রয়োজনের তুলনায় এ নির্বাচনে আইনশৃংখলা বাহিনী অনেক বেশি। তাই আলাদাভাবে সেনাবাহিনীর টহল আপাতত প্রয়োজন হবে না। তবে প্রয়োজন হলে যে কোনো মুহূর্তে তারা টহল দেবেন।