দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২২ এপ্রিল: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ উন্নয়ন এজেন্ডার পটভূমিতে দারিদ্র্য ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইসহ ৩টি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর ওপর গুরুত্বারোপ করে এশিয়া ও আফ্রিকার নেতৃবৃন্দকে শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ বিশ্ব (গ্লোবাল সাউথ) গড়ার লক্ষ্যে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তের আহ্বান জানিয়েছেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি বিশ্বাস করি আমরা সম্মিলিতভাবে এমন এক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবো-যা হবে নির্যাতন,অসহিষ্ণুতা,সহিংসতা ও চরমপস্থামুক্ত।শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৫ উন্নয়ন এজেন্ডা পরবর্তী পরিবর্তনশীল করণীয় ও লক্ষক্ষ্যর রূপরেখা নির্ধারণ করা হচ্ছে।এ প্রসঙ্গে তিনি ৩টি উন্নয়ন ইস্যুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।প্রথমতঃ ক্ষুধা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, দ্বিতীয়তঃ সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপস্থা দমন এবং তৃতীয়তঃ ঘনিষ্ট ও দৃঢ় সহযোগিতা।প্রধানমন্ত্রী বুধবার সকালে বালাই সিদাং জাকার্তা কনভেনশন সেন্টারে দ্বিতীয় এশিয়ান-আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ভাষণে এ আহ্বান জানান।৩ দিনব্যাপী এ সম্মেলন আজ শুরু হয়েছে।
টেকসই উন্নয়নের পূর্ব শর্ত হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি ও নিরাপত্তা এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অস্থিতিশীল বিশ্ব নিরাপত্তা পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অব্য্যহত ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।এক্ষেত্রে তিনি সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম বা জাত নেই। যে কোন হিংসাত্মক কর্মকান্ডে যে কোন ব্যক্তি ও সংগঠনকে আমাদের ভূমি ব্যবহার করতে না দেয়ার নীতিতে সকলকে অটল থাকতে হবে।শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির মোকাবেলায় দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করছে। তারা (স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি) আমাদের দেশের উদার প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধ্বংসে এখনো সক্রিয় রয়েছে। তাঁর সরকার আদর্শিকভাবে সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থাকে পরাজিত করতে গণতান্ত্রিক ও ধর্ম নিরপেক্ষ ধারা শক্তিশালী এবং নারীর ক্ষমতায়ন জোরদার করেছে।
তিনি বলেন, শান্তি ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতির ইতি টানতে তাঁর সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যা সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনতে অঙ্গীকারাবদ্ধ রয়েছে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা, শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই এবং মানবপাচার রোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমাত্রিক সহযোগিতার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।তিনি বলেন, বিশ্বের অর্ধেক জিডিপি’র ধারক হচ্ছে দক্ষিণ। এখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অর্ধেক ও বিশ্ব বাণিজ্যের অর্ধেকেরও বেশি সাধিত হয়। এজন্য টেকসই উন্নয়ন ও দক্ষিণের দেশগুলোর স্বনির্ভরতা অর্জনে দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনা বলেন, ব্যাপক উন্নয়ন সত্ত্বেও বিশ্বের ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। ৮শ’ মিলিয়ন মানুষ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষুধায় ভুগছে এবং ২শ’ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ুর প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এ প্রেক্ষাপটে গণমুখী, দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈশ্বিক উন্নয়নবান্ধব কৌশল নিশ্চিত করতে বিদ্যমান উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষিণের অর্থনীতিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ আগামী মাসে ঢাকায় ২০১৫ উন্নয়ন এজেন্ডা পরবর্তী পটভূমিতে উচ্চ পর্যায়ের এক দক্ষিণ-দক্ষিণ ও ত্রিমাত্রিক সহযোগিতার আয়োজন করছে। আমরা আশা করছি এতে আপনাদের সমর্থন, সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে উল্লেখিত সব বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে।অভিবাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখন মানুষের চলাচল ও অভিবাসন নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। এসব কিছুকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার প্রধান চালিকা ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, অনেক দেশের অভিবাসী শক্তি অর্থনীতি ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখছে। এ খাতে আমাদের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ব্যাপক উন্নয়ন সুফল বয়ে আনতে পারে।এ অঞ্চলে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় দুই মহাদেশের সকল দেশের দৃঢ় অঙ্গীকারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।এ প্রসঙ্গে তিনি জলবায়ু প্রভাব প্রশমনে তাঁর সরকার চাপ সহনশীল (খরা ও বন্যা) ফসলের জাত উদ্ভাবন ও নিজস্ব সম্পদে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের কথা উল্লেখ করেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা কোন একক দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আমি এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনে দৃঢ় অঙ্গীকারের আশায় তাকিয়ে আছি।শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়নের ধারণার ভিত্তি হচ্ছে শান্তি ও উন্নয়ন। তিনি বলেন, আমরা জনগণের, বিশেষত নারীদের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করি, যা দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র বিমোচনে বাংলাদেশ উদাহরন দেয়ার মতো ভালো ফল করেছে, ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২৪ শতাংশে হয়েছে।তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) অধিকাংশই অর্জন করেছে। বৈশ্বিক মন্দা সত্ত্বেও গত ছয় বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স তিনগুণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাড়ে ছয়গুণ বেড়েছে।শেখ হাসিনা বলেন, জনশক্তি দেশের অর্থনীতি ও সমাজের বড় শক্তি। তিনি বলেন, ‘তরুণ জনগোষ্ঠির দক্ষতা ও সামর্থ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা আরও বিনিয়োগ করছি।শিক্ষা খাতে ঈর্ষণীয় অর্জন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার দরিদ্র পরিবারের প্রায় ১২ দশমিক ৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিচ্ছে এবং উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে।তিনি বলেন, এ বছরের প্রথমদিন সারা দেশে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ৩৩০ মিলিয়ন পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। এটা সম্ভবত বিশ্বের মধ্যে এ ধরনের বৃহত্তম কর্মযজ্ঞ।তিনি বলেন, বিভিন্ন জনমুখী উদ্যোগের মাধ্যমে তাঁর সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্যে অগ্রগতি অর্জন করেছে।বিবৃতিতে শেখ হাসিনা সে সব মহান নেতাদের স্মরণ করেন, যাদের দূরদৃষ্টি এশিয়ান-আফ্রিকান সহযোগিতার পথ প্রশস্ত করেছে।
তিনি বলেন, ‘তাঁরা একসাথে একটি সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছেন। সংহতির জায়গা থেকে তাঁরা ঔপনিবেশিকতাবাদ, দারিদ্র্যতা এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার অঙ্গীকার করেছিলেন।এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি যুদ্ধ, সংঘাত ও শোষণমুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্বের স্বপ্ন দেখতেন।তিনি বলেন, তিনি (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) বাংলাদেশের জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন।শেখ হাসিনা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন একটি বিশ্ব দেখতে আগ্রহী ছিলেন, যেখানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা মানবজাতির মধ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনবে। তিনি বলেন, এই বিশ্বাস থেকেই ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সম্মেলনে যোগদান করেন, যা ছিল বান্দুং সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বুধবার ইন্দোনেশিয়ার বালাই সিদাঙ্গ জাকার্তা সম্মেলন কেন্দ্রে সাক্ষাৎ করেছেন কাতারের উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমাদ বিন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।ইন্দোনেশিয়ায় চলমান দ্বিতীয় এশিয়ান-আফ্রিকান সম্মেলনের পাশপাশি তাঁরা এ বৈঠক করেন।বৈঠককালে তাঁরা দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী নিয়ে আলোচনা করেন।উল্লেখ্য, তিনদিনের এই সম্মেলন সকাল থেকে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় শুরু হয়েছে।