17036_1

দৈনিকবার্তা-হাটহাজারী, ২১ এপ্রিল: দেশের একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহকারীদের হতাশ করে ডিম ছাড়ল কার্প জাতীয় (রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ) মা-মাছ। অতীত ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে মেঘের গর্জন ও প্রবল বর্ষন ছাড়াই নদীতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে সৃষ্ট স্রোতে গত মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) দিবাগত রাত আনুমানিক ১টার দিকে ডিম ছেড়েছে মা-মাছ। তবে বিগত বছরের তুলনায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ কম হওয়ার কারণে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে হতাশার চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ডিম ছাড়ার স্থান সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গত মঙ্গলবার রাত ১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাধিক ডিম সংগ্রহকারীরা ৩০০-৩২০ নৌকা, জাল ও ডিম আহরণের সরঞ্জাম নিয়ে হালদার হাটহাজারী অংশের গড়দুয়ারা, নয়াহাট বাজার, মেখল কাটাখালীর টেক, গড়দুয়ারা পাতাইজ্যার টেক, আজিমার ঘাট, আমতোয়া, উত্তর মাদর্শা মাচুয়া ঘোনা, রহমত ঘোনার টেক, রামদাশ্যার হাট, দক্ষিণ মাদার্শা আমতলী ও রাউজান অংশের কচুখাইন, মোকামী পাড়া, আবুর খীল, মগদাই, কাগতিয়ার টেক, উরকিরচর, পশ্চিম বিনাজুরী, কলিপা ঘোনা, বাড়িয়া ঘোনা, মইশকরম, নাফিতের ঘাট, পুরালিয়া খাল দক্ষিণ গহিরা, মোবরক খীল, মঘাশাস্ত্রি বড়ুয়া পাড়া, অংকুরী ঘোনা, বদুর ঘোনা, কোতোয়ালী ঘোনা এলাকায় বিভিন্ন স্পটে জেলেরা ডিম আহরণ করেছে।

ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হালদা নদীর গড়দুয়ারা, রামদাস মুন্সির হাট, নয়াহাট বাজার, অংকুরী ঘোনা, খলিপা ঘোনা, মধ্যম মাদারশা, বশির মোহাম্মদ সিপাহীর ঘাট, নাপিতের ঘাট এলাকায় ডিম সংগ্রহকারীরা বেশি পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছে। এ সময় প্রতিটি নৌকায় গড়ে আধা বালতি- দুই বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করলে নদীতে ডিম ছাড়ার পরিমাণ কম হওয়ায় অনেকেই খালি হাতে তাদের পল্লীতে ফিরে যেতে দেখা গেছে। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলোতে এক একটি নৌকায় দশ থেকে পনের বালতিরও বেশি ডিম সংগ্রহ করেছিল ডিম আহরণকারীরা। এতে করে ডিম সংগ্রহকারী ডিম আহরণকারীদের পল্লীতে খুশির আমেজের পরিবর্তে দেখা গেছে হতাশার চিত্র।

হাটহাজারীর গড়দুয়ারা এলাকার সব চেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহকারী মো. কামাল উদ্দিন সওদাগর এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, এ বছর হালদায় নদী থেকে আমি প্রতিটি নৌকায় গড়ে প্রায় ৫-৬ বালতি করে ৭টি নৌকায় প্রায় ৩৫ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছি। এছাড়া অংকুরী ঘোনা এলাকার বিতান বড়–য়া জানান, তিনিও ৩টি নৌকা দিয়ে গড়ে ২-৩ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছে। তারা উভয়ে আরো জানান যে, এবার (চলতি বছরে) যতটুকু ডিম সংগ্রহ করেছি তা বিগত বছরের তুলনায় অনেক কম।

এদিকে বিগত ও বর্তমান সময়ে হালদা নদীতে নির্বিচারে মা-মাছ নিধন, হালদার বাঁক কাটা, ডিম ছাড়ার পরিবেশ নষ্ট, রাবার ড্যাম ও এশিয়ান পেপার মিল ও রিফ লেদার লিমিটেড নামক ওই প্রতিষ্টানের ট্যানারির অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে যদি পতিত না হত তা হলে আরো অধিক পরিমাণে ডিম ছাড়ত মা-মাছ বলে মনে করেন হালদা নদী বিশ্লেষকরা।

নাম প্রকাশে অনিশ্চুক এক হ্যাচারীর সহকারী এ প্রতিবেদককে জানান, অন্যান্য বারের তুলনায় মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কম। এতে করে ডিম সংগ্রহকারীদের চাহিদা সম্পূর্ণরূপে মিটেনি। তার মধ্যে দুই উপজেলার ৭টি হ্যাচারীর মধ্যে ৩টি সচল থাকলেও বাকী ৪টির অবস্থা বেশ নাজুক। তাইতো ডিম সংগ্রহকারীরা তাদের সংগ্রহিত ডিম রেনুতে পরিণত করতে হ্যাচারীতে আসার তেমন কোন চিত্র চোখে পড়েনি।

মৎস অফিস সূত্রে জানা যায়, এ বছর মা-মাছেরা বিশেষ করে গড়দুয়ারা নায়াহাট এলাকায় থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন স্পটে ডিম সংগ্রহ করে ডিম সংগ্রহকারী। তবে মা-মাছ ডিম ছাড়ার পর নাদীতে জোয়ার থাকায় নদীর উপরের দিকে সমস্ত হালদা নদীতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি নৌকায় গড়ে আধা বালতি-পাচঁ বালতি পর্যন্ত প্রতি নৌকায় কম-বেশি ডিম সংগ্রহ করেছে ডিম সংগ্রহকারীরা। সেই হিসাবে নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের পরিমান প্রায় ২১০ বালতি বা ১ হাজার ৬৮০ কেজি পর্যন্ত। আর এই সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম থেকে রেনু উৎপাদন হবে প্রায় ১২০-১৩০ কেজি। আর ওই উৎপাদিত রেনুর বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি প্রায় ৩৫-৪০ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও হালদা গবেষক মনজুরুল কিবরিয়া সাথে এই বিষয়ে মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, অতীত ঐতিহ্যকে পেছনে ফেলে মেঘের গর্জন ও প্রবল বর্ষন ছাড়াই নদীতে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে সৃষ্ট স্রোতে ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা-মাছ। তাই নদীতে ডিম সংগ্রহকারীরাও প্রস্তুতি ছিল না। ডিম সংগ্রহকারীরা আশানুরুপ ডিম সংগ্রহ করতে না পারলেও যা ডিম তারা (জেলেরা) নদী থেকে আহরণ করেছে তাতে তাদের দূদাশা কিছুটা দূরবিত হতে পারে, তাই তারা কিছুটা সন্তুষ্ট।

তবে এর জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদাসিনতা তথা মা-মাছ নিধন, হালদার বাঁক কাটা, ডিম ছাড়ার পরিবেশ নষ্ট, রাবার ড্যাম ও এশিয়ান পেপার মিল ও রিফ লেদার লিমিটেড নামক ওই প্রতিষ্টানের ট্যানারির অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পতিত হওয়াকে দায়ী করে বলেন, যদি এমন প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি না হলে মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ আরো বাড়ত।এই ব্যাপারে হাটহাজারী উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, হালদা এবার

যে পরিমাণে মা-মাছ ডিম ছেড়েছে কম নয়। তবে মা-মাছেরা যদি আমবস্যা পূর্ণিমাতে ডিম ছাড়ত তাহলে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বেশি হত। এছাড়া তিনি দ্বিতীয় দফায় মা-মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়তে পারে বলে নিশ্চিত করেন।

এছাড়া এবার মৎস্য দস্যুরা নির্বিচারে মা-মাছ নিধন করতে পারেনি। তবে মা-মাছ যাতে নিরাপদে ফিরে
যেতে পারে এবং কেউ যাতে মা-মাছ শিকার করতে না পারে সে জন্য আমাদের অভিযান তথা পুলিশি টহল অব্যাহত ছিল ও থাকবে বলে তিনি জানান। এদিকে নদীতে স্বল্প পরিমাণে ডিম সংগ্রহের পর থেকে কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে করে প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারীদের মধ্যে আতংকে ভুগছে। কৃত্রিম রেনু পোনা উৎপাদন কারী ও বিক্রেতারা তৎপরতা সর্ম্পকে জেলা মৎম্য কর্মকর্তা ও হালদা প্রকল্প পরিচালক প্রভাতী দেব এর কাছে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, এই রকমের কোন কিছু আমি দেখিনি। আমার দুই উপজেলা দায়িত্বে থাকা মৎস্য কর্মকর্তা সার্বক্ষনিকভাবে হালদা পাড়ে রয়েছে। যদি এরকমের কোন কিছু দেখা যায় তা হলে তারা তাৎক্ষনিকভাবে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করবে।

অবশ্য এর আগে ২০১১ সালে হালদা নদী থেকে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৬০০ কেজি। পরের বছর ২০১২ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ২১ হাজার ২৪০ কেজি। ২০১৩ সালে তা একবারে কমে দাড়ায় ৪ হাজার ২০০ কেজি। এরপর ২০১৪ সালে আবার বেড়ে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৫০০ কেজি। তবে এবার এ সংখ্যা আরও কমে দাড়িঁয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬৮০ কেজির মত। উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র মিঠা পানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র মিঠা পানির এই হালদা নদী বিশ্বের একমাত্র অন্যতম জোয়ার-ভাঁটার নদী। এখানে প্রতি বছর এই সময়ে কার্প জাতীয় রুই, কাতাল, মৃগেল ও কালিবাইশ সহ বিভিন্ন প্রজাতির মা মাছের নিষিক্ত ডিম ছাড়ে এবং জেলেরা ডিম সংগ্রহ করে পরে তা কয়েক দফায় বিকিকিনি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে। অপার এই জীব বৈচিত্র ও মৎস্য সম্পদের অন্যতম রূপালী খনি জাতীয় অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রেখে চলেছে বহু বছর ধরে।