দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ২০ এপ্রিল: ভোটে নির্বাচিত হলে ঢাকাকে একটি ভালো নাগরিক শহরে রূপান্তরিত করার জন্য সরকার, প্রশাসন ও সকল রাজনৈতিক দলসহ সবার সমন্বয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করলেন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ছয় মেয়র প্রার্থী। এ সময় তারা খুব দ্রুত ঢাকা শহরের সব সমস্যা সমাধান করে একটি আধুনিক শহর করারও প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন। সোমবার দুপুরে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো আয়োজিত যদি আমি মেয়র হই শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ অঙ্গিকার করেন।গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেওয়া ছয় মেয়র পদপ্রার্থী হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আনিসুল হক, তাবিথ আউয়াল, মাহী বি চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল ক্বাফী ও জোনায়েদ সাকী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন। ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠান থাকায় গোলটেবিলে উপস্থিত হতে পারেননি ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস।গোলটেবিলে তিনজন বিশেষজ্ঞ বক্তব্য দেন। তাঁরা হলেন-নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারওয়ার জাহান ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক বলেন, আমি মেয়র হলে নগরবাসীর সমন্বয়ে সমন্বিত কমিটি গড়ে নগর ভবনকে নাগরিক ভবনে পরিণত করবো।এই সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে ঢাকা নগরীর সব সমস্যাগুলো প্রথমে চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানকল্পে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আর সে অনুযায়ী কাজ করা হবে। কেননা ঢাকার উন্নয়ে একটি সমন্বিত যাত্রা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, আমার একটি টিম ইতিমধ্যে ২০ হাজার ২৫২ জনের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে দেখেছে, বর্তমান ঢাকাবাসীর মধ্যে ৬৮ ভাগ লোকের প্রধান সমস্যা হচ্ছে মশা। এই মশা নির্মূল করতে হলে প্রথমে ঢাকা থেকে আবর্জনা মুক্ত করতে হবে। এক কথায় ঢাকা ‘গ্রিন সিটি ও ক্লিন সিটি’ করতে যা যা দরকার আমি নির্বাচিত হলে তা করবো।আর ঢাকাকে বসবাস উপযোগী করতে মেয়রের যতটুকু ক্ষমতা তা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই দ্রুত কাজে লাগাবো। যেসব কাজের এখতিয়ার মেয়রের থাকে না, সেসব কাজে সরকার-প্রশাসনসহ সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবো’ বললেন আনিসুল হক।
২০ দলীয় জোট সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল বলেন, আমি নিজে ১৫ বছর ধরে ঢাকাকে নিয়ে গবেষণা করেছি। তাই ইতিমধ্যে ঢাকার কি কি সমস্যা তা আমি চিহ্নিত করেছি। আমি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই এসব সমাধানে কাজ করবো। আর এসব সমাধানের কাজ সমন্বয়ের সাথেই করতে হবে। যেমন- যাদের আমরা সেবা দেবো, তাদের কাছে আমাদের জানতে হবে তারা কেমন সেবা চাচ্ছে এবং পাচ্ছে। ঢাকার উন্নয়নের জন্য সে অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে।তাবিথ বলেন, ঢাকা শহরের সকল সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক কোনো কিছু না করা। আমাদের নগরায়ণ ব্যবস্থায় কোনো পরিল্পনা নাই। আর এই জনবহুল নগরীকে আধুনিক ও নাগরিক সুবিধা সমৃদ্ধ শহর করতে গেলে প্রথমে পরিকল্পনানুযায়ী কাজ করতে হবে। তাই আমি নির্বাচিত হলে প্রথমে যেসব পরিকল্পনা নিয়েছি সে অনুযায়ী কাজ করবো।
ঢাকা এখন অনিরাপত্তার শহর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সেক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। কেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বাড়ছে? নিরাপত্তার এ অভাব দূর করা হবে। ক্রাইম কমাতে ওয়ার্ডভিত্তিক একটি ম্যাপিং সিস্টেম চালু করা হবে। কথা দিচ্ছি মেয়র হলে পুলিশ কমিশনারকে নিয়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবো।প্রজন্ম বাংলাদেশ ও প্রজন্মের শহর’ গড়ার প্রতিশ্র“তি দিয়ে মাহী বি. চৌধুরী বলেন, এখানে যারা এসেছেন সবারই পরিকল্পনা অনেক সুন্দর। কিন্তু মেয়র একজনই হবেন। তাই সবাইকে নিয়েই কাজ করতে হবে। কথা দিচ্ছি আমি মেয়র হলে বর্তমানে যারা মেয়র প্রার্থী আছেন সবার সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি করবো। যাদের নিয়ে আধুনিক ঢাকা গড়তে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।তিনি বলেন, আমাদের সমস্য কি তা ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে। তাই এগুলো সমাধান কিভাবে করতে হবে সেদিকে নজর দিতে হবে। মেয়রের এখতিয়ারের মধ্যে যেগুলো আছে সেগুলো আগে পদক্ষেপ নিবো। এছাড়া বাকি কাজগুলো সরকারের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি বা সমন্বয়ের মাধ্যমে করবো।মাহী আরো বলেন, সমাজে ৯ বছরের নিচে বয়স এমন তিনজনে একজন কন্যাশিশু নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু সেটি গোপন থাকছে। বিষয়টি সামনে আনতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি যদি মেয়র হই তাহলে নারী নির্যাতনসহ এগুলোর প্রতিকার করবো।আর ন্যায় বিচার ও দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য প্রতিটি মহল্লায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমিটি ফোর ট্রান্সপেরেন্সি নামে কমিটি গঠন করবেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জুনায়েদ সাকি বলেন, আমি মেয়র হলে নগর সরকার গঠনের বিষয়ে নাগরিকদের মত নেবো। এখন সময় হয়েছে নগর সরকার তৈরির। অধিকার ও দায়িত্বের মিলে মিশেই সাফল্য আসবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনে কঠোরতার সঙ্গে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হবে।ঢাকা শহর নারী ও শিশু বিদ্বেষী’ শহরে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীদের জন্য এখানে পাবলিক টয়লেট পর্যন্ত নেই। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে এমন ঘটনার এতোদিন পর পুলিশ সন্দেহ প্রকাশ করে বলছে, আদৌ এমন ঘটনা ঘটেছে কি না। এ শহর শিশু বিদ্বেষী শহরে পরিণত হয়েছে। তারা এখানে নিরাপদ নয়। তাই আমি নির্বাচিত হলে প্রথমে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, আমি আমার বাবার স্পিড নিয়ে কাজ করছি। আর আধুনিক ঢাকা গঠনে এই মুরাল স্পিডকেই কাজে লাগাবো। আধুনিক ঢাকা গড়তে বাবার যেসব স্বপ্ন পূরণ হয়নি তা বাস্তবায়ন করার চেষ্ঠা করবো। আর ঢাকার সব সমস্যার সমাধানের জন্য দলমত নির্বিশেষে কাজ করবো।তিনি আরো বলেন, আমি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম বছর ঢাকার যাবতীয় সমস্যা সমাধান করবো। দ্বিতীয় বছর থেকে শেষ সময় পর্যন্ত এই শহরকে আন্তর্জাতিক শহর কিভাবে করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করবো।আবদুল্লাহ আল ক্বাফী বলেন, আমি নির্বাচিত হলে প্রথমে শিক্ষা স্বাস্থ্য নিশ্চিত করবো। আর উন্নয়নের প্রধান বাধা চাঁদাবাজ, মাস্তানদের নির্মূল করবো। আর যানজটসহ ঢাকার যতগুলো সমস্যা আছে সেগুলো নির্মূল করবো। আর আমি কি কি করবো তা আমার ৭১ নির্বাচনী অঙ্গিকারে বলা আছে।আর জনগণ যদি তাদের কাঙ্ক্ষিত ঢাকা চায়, তাহলে আমাকে ভোট দিতেই হবে’ বলেও যোগ করেন ক্বাফী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী সাঈদ খোকন বলেন, মেয়র নির্বাচিত হলে প্রথমেই বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষদের নিয়ে একটি সংলাপ করবেন তিনি। নাম হবে ঢাকা ডায়ালগ। এর ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন তিনি।
নতুন প্রার্থী এবং তাঁদের বিভিন্ন প্রতিশ্র“তির কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমি আনন্দিত ও আশান্বিত। আমি ভাবছি, এত দিন উনারা কোথায় ছিলেন। উনারা নিশ্চয়ই ঢাকাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমি মনে করি, এঁদের মধ্যে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনি ঢাকাকে এগিয়ে নিতে পারবেন।সম্ভাব্য মেয়রদের কাউন্সিলরদের সমন্বয়ে কাজ করতে পরামর্শ দেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।দলমত-নির্বিশেষে নগরভবনকে নগরবাসীর সেবাকেন্দ্রে পরিণত করার প্রতিশ্র“তি দিয়ে সাঈদ খোকন বলেন, তাঁর বাবা ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ নগর সরকার এর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হলে তিনিও নগর সরকার করার উদ্যোগ নেবেন। গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। শুরুতেই সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি। মেয়র পদপ্রার্থীদের উদ্দেশে সূচনা বক্তব্যে মতিউর রহমান বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়রদের ভালো কাজে সমর্থন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ভুল কাজের সমালোচনা করা হবে।