দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৪ এপ্রিল: কালের গহবরে হারিয়ে গেল আরোএকটি বাংলা বছর।ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষেঅসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালী ১৪২২বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিচ্ছে বর্ণিল উৎসবে।মঙ্গলবার বর্ষ বরণ উপলক্ষে তাই রাজধানী ঢাকা সেজেছিল উৎসবমুখর পরিবেশে।বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শেকড়ের সন্ধানে লোকায়ত সংস্কৃতির নানা উৎসব দিয়ে পয়লা বৈশাখকে বর্ণিল আয়োজনে বরণ করতে ব্যস্ত।জাত-পাত ও ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সকলে যার যার মত ব্যস্ত। ঘরে ঘরে চলছে উৎসব উদযাপন। বর্ষবরণের পোশাকে কয়েক বছর যাবতই লাল-সাদা রঙের পাশাপাশি অন্যান্য রঙের ট্রেন্ডও চালু হয়েছে।মঙ্গলবার ভোরের প্রথম প্রভাতে বর্ষবরণের এ উৎসবকে স্বাগত জানিয়ে আসছে ছায়ানট। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এটি তাদের বর্ষবরণের ৪৭তম আয়োজন। সাম্প্রতিক সময় বিবেচনায় ছায়ানট উৎসবের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে-শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার।
ছায়ানটের বর্ষ বরণ উৎসবশেষ হওয়ার পর পরই শুরুহয় মঙ্গলশোভাযাত্রা।এবারশোভাযাত্রারঅগ্রভাগেথাকেবিশালাকৃতির ভাস্কর্য। চারুকলার লিচুতলায় বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কাঠামো।ইতোমধ্যে আপন চেহারা পেয়েছে ছাগল ও ছাগল ছানা, মাছ, পাখি, হাতিসহ আটটি ফোক মোটিভ।মঙ্গল শোভাযাত্রার খুঁটিনাটি তুলে ধরে অনুষদের ডিন শিল্পী নেসার আহমদ বলেন, বর্তমান পারিপার্শিকতা বিবেচনা করে এবার আমরা প্রতিপাদ্য নির্বাচন করেছি-‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে চতুর্থবারের মতো চ্যানেল আই ও সুরের ধারা চৈত্র সংক্রান্তি ও বর্ষবরণের আয়োজন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউট চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ-১৪২২ উদযাপন উপলক্ষে বর্ণাঢ্য কর্মসূচি গ্রহণ করে। থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগবাংলাদেশসরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমবারের মতো নাট্য-মন্ডল প্রাঙ্গণে ও মিলনায়তনে চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ৪ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আয়োজনের অংশ হিসেবে নাট-মঙ্গল মিলনায়তনে প্রতি সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ মধ্যযুগের বাংলা নাট্য পদ্মাপুরাণ অবলম্বনে চম্পকনগরের উপকথা।
সংগীত বিভাগ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ১৪ এপ্রিল সকাল ৮টায় কলাভবনের সামনে বটতলায় বাংলা গানের আসরের আয়োজন করে। এ ছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ১৪ এপ্রিল বিকেল ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব চত্বরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।পয়লা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে রাজধানীর রমনা পার্ক এলাকায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মঙ্গলবার সকাল থেকেই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানীর রমনা পার্ক এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
পয়লা বৈশাখকে ঘিরে রমনা পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় ৪০ প্লাটুন পুলিশ সদস্য, ২৫০ জনেরও বেশি র্যাব সদস্য, প্রায় ৩০০ জন আনসার সদস্য জনসাধারণের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। এ ছাড়াও ৩০টি সোয়াট টিম এবং সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছে। রমনা পার্ক এবং সোহরাওয়ার্দীতে আগত দর্শনার্থীরা যাতে নির্বিঘেœ এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারে সেজন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। র্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রাস্তার ওপর হকারদের সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ।এ ছাড়া কেউ হারিয়ে গেলে পুলিশ এবং র্যাবের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ এই শ্লোগানে বাংলা নতুন বছর ১৪২২ উদযাপনে বাসাবো বালুর মাঠে চলে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠানমালা। সকাল ৭টায় সংগঠনের শিল্পীদের দলীয় পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর থাকে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন শাখা সংসদের শিল্পীদের পরিবেশনা। এতে রয়েছে একক সঙ্গীত, আবৃত্তি, নৃত্য ও লাঠিখেলা।বাংলা শুভ নববর্ষকে বরণ করতে বর্ণাঢ্য ও মনোলভা শোভাযাত্রা করে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। বাঙালির চিরায়ত নানা অনুষঙ্গ যেমন ঢাক- ঢোল, গরুর-ঘোড়ার গাড়িসহ নানা সাজে সজ্জিত হয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই শোভাযাত্রা। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে শোভাযাত্রটি শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন পথ পরিভ্রমণের পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এসে শেষ হয়।
সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার প্রতিরোধ করার প্রত্যয় ও আহ্বান নিয়ে আজ রাজধানী ঢাকায় পয়লা বৈশাখ ১৪২২ উপলক্ষে বের হয়েছে মঙ্গল শোভাযাত্রা।সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে শোভাযাত্রায় ছিল প্রায় ২০ ফুট লম্বা একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। হাত হচ্ছে দেশের শান্তিকামী মানুষ। আর হাতের একটি আঙুলে ছিল লাল রং। এই লাল রং সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতীক।বিশেষ কাঠামো হিসেবে রয়েছে, হাতের থাবা দিয়ে মানুষের গলা চেপে ধরা- এই প্রতীক দিয়ে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাবলি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার স্লোগান ছিল, অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে আজ সকাল ৯ টায় শোভাযাত্রাটি শুরু হয়। এর পর শোভাযাত্রাটি রূপসী বাংলার মোড় হয়ে ঘুরে আবার চারুকলার সামনে গিয়ে শেষ হয়।শোভাযাত্রায় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায়, তোতাপাখি, হাট্টিমা টিম টিম, কাকাতুয়া, মাছ, বাঘ, পায়রা, হাতিসহ ১১টি বড় কাঠামো রয়েছে। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রয়েছে ছাগল ও দুটি ছানা। কলসি হাতে মা তার সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন গ্রামীণস্তৃশ্যও রয়েছে শোভাযাত্রায়।এ ছাড়া রয়েছে মুখোশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা রাজা-রানী, উজির-নাজির, বাঘ, পেঁচা, টেপা পুতুলসহ নানা আকৃতি ও বর্ণের প্ল্যাকার্ড।বাঙ্গালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না। তখন এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে এর নাম হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
প্রায় ২০ ফুট উঁচু বিশাল এক হাতে মুক্তবুদ্ধির কণ্ঠরোধের প্রতীকী উপস্থাপনায় সাম্প্রদায়িক অশুভ শক্তির উত্থানের চিত্র তুলে ধরে রুখে দাঁড়ানোর ডাক এসেছে বর্ষবরণের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রায়’। অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলা বর্ষবরণের এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ।মঙ্গলবার সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয় শোভাযাত্রা। রূপসী বাংলা মোড় ঘুরে টিএসসি হয়ে ফের চারুকলার সামনে এসে শেষ হয় এই বর্ণিল যাত্রা।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও নানা শ্রেণি-পেশা, ধর্ম-বর্ণ ও নানা বয়সের হাজারো মানুষ মঙ্গল যাত্রায় যোগ দেন। বাবা-মায়ের হাত ধরে, ঘাড়ে চড়ে শিশুদেরও দেখা যায় সারিবদ্ধ মানুষের উচ্ছ্বল পদচারণায়।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ওপর ভিত্তি করে আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রতীকী আকারে উঠে এসেছে এই শোভাযাত্রায়।অসাম্প্রদায়িক বাংলার মাটিতে উগ্রবাদী হামলায় লেখক অভিজিৎ রায় ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান খুন হওয়ার গ্রেক্ষাপটে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে বেছে নেওয়া হয় এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য। এই প্রেক্ষাপট নিয়েই শোভাযাত্রার প্রধান প্রতীকটি তৈরি করা হয়; প্রায় ২০ ফুট লম্বা মুষ্টিবদ্ধ হাত, যার আঙুলে রয়েছে লাল রং। এই বিশাল হাত গলা টিপে ধরেছে সাধারণ মানুষের।
শোভাযাত্রায় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রধান প্রতীক ছাড়াও বড় আকারের প্রতীকের মধ্যে ছিল কাকাতুয়া, ময়ুর, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, ছাগল ও টেপা পুতুলসহ ১১টি কাঠামো। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ছিল ছাগল ও দুটি ছানা।
কলসিসহ বাঙালি গৃহবধূ দাঁড়িয়ে আছেন তার সন্তানকে নিয়ে- এমন গ্রামীণ দৃশ্যের উপস্থাপনাও দেখা যায় শোভাযাত্রায়।বিশাল আকারের মাছের পাশাপাশি কয়েকশ মাঝারি ও ছোট আকারের মুখোশ, পাখ-পাখালি ছিল সেখানে। মুখোশ পরে, কেউ বাহারি সাজে বর্ণিল এ শোভাযাত্রায় ছিলেন হিজড়াও।উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কালো ছায়া দূর করে বিশ্ব মানবতার মনে আলো ছড়িয়ে দিতে এবং শান্তি-কল্যাণের হিতার্থে এই শোভাযাত্রা। পুরাতন বছরের যে জড়তা, গ্লানি ও আঁধার রয়েছে মানুষের মনে, বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে সেই কালো ছায়া দূর করে নতুন জীবন গড়ার কামনা ও প্রত্যাশা করছি। চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের মতে,বাঙালির লোকজ ঐতিহ্যে ধর্মের সহাবস্থান রয়েছে, কিন্তু দ্বন্দ্ব নেই।
তাই ধর্মান্ধতার অশুভ বিকাশের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন তারা।এঙ্গলবার দিন ব্যাপী রমনার আশপাশে তিল ধারণের ঠাই ছিল না ।সবত্রই মানুষের ঢল নামে নববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত এই শোভাযাত্রা এরইমধ্যে বাঙালির বর্ষবরণের কেন্দ্রীয় আয়োজনের একটি হিসাবে স্থান করে নিয়েছে; ঢাক- ঢোল পিটিয়ে, নেচে- গেয়ে যেখানে অংশ নিয়েছে সব বয়সের সব শ্রেণি- পেশার হাজারো মানুষ।নির্বাচন পরবর্তী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপটে গতবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান।
পৃথিবীর আবর্তনে প্রতিদিনের মতো সূর্য উঠলেও মঙ্গলবার ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে তা এসেছে বাংলাদেশে। এ সূর্য যে ভোর নিয়ে এলো, তা সূচনা ঘটালো বাংলা নতুন বছরের। স্বাগত ১৪২২। সূর্যোদয়ে চিরনতুনের ডাক দিয়ে আসা পহেলা বৈশাখ যেন রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে বাঙালির মনে, যার টওকাশ ঘটেছে নারী-পুরুষের রঙিন সাজে, শিশুর মুখে ফুটে ওঠা আনন্দের হাসি আর বর্ণিল পোশাকে।নানা আয়োজনে, নানা আঙ্গিকে বর্ষবরণ চলছে সারা দেশজুড়ে। পূব আকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর রমনার বটমূলে শুরু হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন।
সেই কাকডাকা ভোর থেকেই নগরবাসীর অনেককেই ছুটতে দেখা যায় রমনা পানে। বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজন শুরুর বেশ আগে থেকেই সেখানে দলে দলে সমবেত হতে থাকে মানুষ। অনুষ্ঠান শুরুর পর জনতার ঢল নামে রমনায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বটমূলের অনুষ্ঠানস্থল উপচে মানুষ ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে। এক সময় পুরো রমনাই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ঘড়ির কাটায় সোয়া ৬টা বাজতেই রমনার মঞ্চ থেকে ভেসে আসে সেতারের সুর। এর মধ্য দিয়ে ছায়ানটের শিল্পীরা নতুন বছরকে স্বাগত জানান। এরপর চলে রবীন্দ্র সংগীত। শিল্পীদের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ হন হাজারো শ্রোতা।
শান্তি, মানবতা ও মানুষের অধিকার’ শিরোনামে ছায়ানট পহেলা বৈশাখ উদযাপন করছে। প্রতি বছরের মতো এবারও ভক্তিরস ও দেশপ্রেমের একক এবং দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করছেন ছায়ানটের শিল্পীরা।এই উৎসবে যোগ দিতে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের সঙ্গে বাবা-মার হাত ধরে রমনামুখী হয়েছে শিশুরাও। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আর্চওয়ে পার হয়ে পার্কে ঢুকতে দেওয়া হয়।সকাল ৭টার আগেই রমনায় প্রবেশে দীর্ঘ লাইন পড়তে দেখা যায়। আগতদের বাতাসা আর গোলাপ ফুল তুলে দিয়ে বর্ষবরণ উৎসবে স্বাগত জানান পুলিশ সদস্যরা। সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ছায়ানটের শিল্পীরা জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মেলান হাজারো মানুষ।
লাল পাড়ের সাদা শাড়িতে নারী, আর অধিকাংশ পুরুষকে দেখা যায় পাজামা-পাঞ্জাবিতে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে রমনা পার্ক ও আশপাশের এলাকা।বেশ কয়েকজন বিদেশিকেও দেখা গেছে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে রমনার উৎসবে যোগ দিতে। এদের কারো কারো গালে ফুটে উঠেছে বৈশাখী আলপনা।রমনায় ছায়ানটের আয়োজনের সমাপ্তি টানার পরপরই শুরু হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।রমনার পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, শিশুপার্ক, বাংলা একাডেমিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের উদ্যোগে সকাল ৮টায় কলাভবনের সামনের বটতলায় বসে বাংলা গানের আসর। সকাল ১০টায় নাট মণ্ডল প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে থাকছে পরিবেশনা।কলাভবনের সামনের সবুজ চত্বরে সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হয় বাংলা বিভাগের দিনব্যাপী আয়োজন। বর্ষবরণের শোভাযাত্রা শেষে সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তির মধ্য দিয়ে চলতে থাকবে আয়োজন। বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় বিকালে থাকবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অবলম্বনে নাটক; আর সন্ধ্যায় সেলিম আল দীন-এর ‘কিত্তনখোলা’।
বাংলা একাডেমি চত্বরে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে সকাল সাড়ে ৭টায়। একক বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্বরচিত ছড়া-কবিতা পাঠে চলছে তাদের বর্ষবরণ। এ ছাড়া বিসিকের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে থাকছে বৈশাখী মেলা।মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে সকাল ৯টা থেকে শুরু হয়েছে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। এতে থাকছে নাচ, বাউল গানসহ নানা পরিবেশনা।বাসাবো বালুর মাঠে সকাল ৭টায় শুরু হয়েছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। সেখানে থাকছে গীত, নৃত্য, আবৃত্তি ও নাটক।বিভিন্ন সমাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে পুরো ঢাকাজুড়েই বর্ষবরণের ছোট ছোট আয়োজন শুরু হয়েছে সকাল থেকেই।বর্ষবরণ উৎসব ঘিরে রমনা পার্ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কড়া টহল রয়েছে।
দুই চাকার একটি যানে (টু-হুইলার) চেপে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে রমনা বটমূলের মঞ্চের আশপাশে টহল দিতে দেখা গেছে। ওয়াকিটকির সঙ্গে অস্ত্রও রয়েছে তাদের কাছে। র্যাবের ওয়াচটাওয়ার থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে পুরো এলাকা। এদিকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির এই উৎসব ঘিরে বিভিন্ন জিনিসের পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। ভিনদেশি ‘ভুভুজেলা’ বাজিয়ে বিকট শব্দ করে মাতোয়ারা হচ্ছেন অনেকেই। আর বাঁশি, একতারা-দোতারা, ঢোলসহ বিভিন্ন ধরনের বাদযন্ত্রও বিক্রি হচ্ছে।পান্তা-ইলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পুলিও বিক্রি হতে দেখা গেছে। রয়েছে চিনির তৈরি বিভিন্ন খাবারও।ঢাকাসহ সারা দেশেই বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। ষোড়ক শতকে আকবর ‘ফসলী সন প্রবর্তনের মাধ্যমে যে বাংলা সাল চালু করেছিলেন সময়ের বিবর্তনে সেই দিনটি এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব পরিণত হয়েছে।আকবরের নবরতœসভার আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে ফসলি সালের গণনা শুরু করেছিলেন। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় করে বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিল নক্ষত্র বিশাখা থেকে।
ইতিহাসের পাতা উল্টে জানা যায়, পয়লা বৈশাখে আকবর মিলিত হতেন প্রজাদের সঙ্গে। সবার শুভ কামনা করে চারদিকে বিতরণ হতো মিষ্টি। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বর্ষবরণ উৎসব চলে আসে জমিদার বাড়ির আঙিনায়। খাজনা আদায়ের মতো একটি রসহীন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় গান বাজনা, মেলা আর হালখাতার অনুষ্ঠান।আজ আর খাজনা আদায় নেই, কিন্তু রয়ে গেছে উৎসবের সে আমেজ। সেটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে শহর বন্দর আর গ্রামে, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির মাঝে।