DoinikBarta_দৈনিকবার্তাworld-bank-logo

দৈনিকবার্তা- ঢাকা, ১২ এপ্রিল: বিশ্বব্যাংক বলছে,রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাংলাদেশে উৎপাদনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির কারণে চলতি অর্থ বছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ৫.৬ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না হলে প্রবৃদ্ধি ৬.৪ শতাংশ থেকে ৬.৬ শতাংশ হতো।রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে দুপুরে ‘দ্য বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শিরোনামে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।বছরের শুরুতেই তিন মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭ হাজার ১৫০কোটি টাকার (২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার) ক্ষতির তথ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক।উৎপাদন খাতের এই আর্থিক ক্ষতির মধ্যে সেবা খাতের ক্ষতির পরিমাণই ৬৮ শতাংশ। এছাড়া ২৫ শতাংশ শিল্প খাতে এবং ৭ শতাংশ কৃষি খাতের ক্ষতি বলে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সহিংসতায় আর্থিক ক্ষতির এই পরিমাণ মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) এক শতাংশ। যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকত তাহলে চলতি ১০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৪ থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হত। যেহেতু এক শতাংশ ক্ষতি হয়ে গেছে, সেহেতু আমাদের হিসাবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

জাহিদ হোসেন বলেন, গত ৫ জানুয়ারি সারা দেশে অবরোধ শুরু হয়; পরে হরতাল। টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে চলে অবরোধ-হরতাল।তবে শেষ দিকে এসে এর ধার কমে গিয়েছিল। সে কারণে আমরা ৬০ দিনের উৎপাদনের ক্ষতির হিসাব করে এই তথ্য দিয়েছি। কোন পদ্ধতিতে ক্ষতির এই হিসাব করা হয়েছে- এমন প্রশ্নে জাহিদ হোসেন বলেন, এই ৬০ দিনে উৎপাদনশীল খাতে দৈনিক যে ক্ষতি হয়েছে তার ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে। ২০১৩ সালে যে অস্থিরতা-সংঘাত হয়েছিল তার হিসাবও একইভাবে করা হয়েছিল।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর বিশ্ব ব্যাংক ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল।গত অর্থবছরে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে।সেই শক্তি দিয়ে নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে তারা অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেন।তাছাড়া বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যে বছর রাজনৈতিক অস্থিরতা হয়েছে তার পরের বছরই ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম দিকের সহিংসতার পর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সেটাই প্রমাণ করে।একই কারণে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি না হলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

এরপর ২০১৬-১৭ অর্থ বছর শেষে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে পূর্বাভাস দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশপাশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।জিডিপি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদন, অর্থ্যাৎ দেশের অভ্যন্তরে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবার উৎপাদন হয়, তার যোগফল।গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জিডিপির আকার ছিল চলতি মূল্যে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এ থেকে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করছে সরকার।বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার বিষয়টিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখবর অভিহিত করে জাহিদ বলেন, শুধু তেল নয়; সার, খাদ্যপণের দামও কম। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সব কিছুই বাংলাদেশের অনুকূলে। বাজেটে সরকারের ভর্তুকি খাতে খরচ অনেক কম হবে।বিশ্ব ব্যাংকের এই অর্থনীতিবিদ বলেন, তেলের দাম কমায় অতীতের পুঞ্জিভূত ক্ষতি থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশের জ্বালানি তেল বিপণন ও সরবরাহকারী সংস্থা বিপিসি। গত বছরের অক্টোবর থেকে লাভ করছে সংস্থটি। কেবল পেট্রোল-অকটেনে নয়, ডিজেল-কেরোসিনেও লাখ করছে বিপিসি।বর্তমানে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই (৫ শতাংশ) আছে বলে মনে করছেন জাহিদ হোসেন।বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত দুই ধরনের মূল্যস্ফীতিই সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই- ফেব্র“য়ারি) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ১০৯ কোটি ডলারের ঘাটতি (ঋণাত্মক) রয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ১৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত ছিল। এছাড়া বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬৪০ কোটি ডলারে উঠেছে।অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভে আছে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটা দিয়ে ছয় মাসের বেশি সময়ের আমদানি দায় মেটানো সম্ভব।জুলাই-মার্চ সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া না হলেও সঞ্চয়পত্র থেকে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ায় ভবিষ্যতে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেন জাহিদ হোসেন।চলতি বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। কিন্তু বিক্রি বাড়ায় আট মাসেই (জুলাই- ফেব্র“য়ারি) লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণের বেশি, প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ হয়ে গেছে সরকারের।বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি ইয়োহানেস জাট সংবাদ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন।

পট্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় ড. জাহিদ বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক বিপত্তির মধ্য দিয়ে গেছে। এ বিপত্তির মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা অন্যতম। তারপরও সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে।চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে অর্থনীতির অনেকগুলো খুবই ইতিবাচক ছিলো। সূচকগুলো যে ভাবে উন্নতি করছিলো তাতে আমরা ধারণা করেছিলাম প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ তো হবেই, তারও বেশি হতে পারে।কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা উন্নতির সে ধারায় বাধা সৃষ্টি করছে। আর এ অস্থিরতা দেখা দেয় অর্থনীতির সোনালী সময়। অস্থিরতায় উৎপাদন ক্ষেত্রে ২.২ বিলিয়ন ডলার বা ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের জিডিপির ১ শতাংশের সমান। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে (২০১৫-১৬ অর্থবছর) প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশ এবং ২০০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬.৭ শতাংশ হতে পারে।তবে এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গতানুগতিক উন্নয়ন যেমন অবকাঠামো খাতে সংস্কার, অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’র (পিপিপি) উন্নয়ন করতে হবে।বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ফাঁদে আটকে গেছে। এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে জিডিপির ৫ শতাংশ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বর্তমানে জিডিপির ২৮.৭ শতাংশ বিনিয়োগ আছে। এটিকে বাড়িয়ে ৩৩ থেকে ৩৪ শতাংশ করতে হবে।

একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে হবে। বর্তমানে ৩৩.৭ শতাংশ নারী শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত আছে। যদি এটি ৪৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া যায় তবে প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি বাড়বে দশমিক ৭ শতাংশ। আর ৭৫ শতাংশে নিতে পারলে ১.৬ শতাংশ এবং ৮২ শতাংশ হলে ১.৮ শতাংশ হারে প্রতিবছর ডিজিপির প্রবৃদ্ধি বাড়বে।প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাই একমাত্র সমাধান নয়। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মুদ্রা বিনিময় হার আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রাখা, আর্থিক খাতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চে যেখানে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৭.৫ শতাংশ, তা ২০১৫ সালের মার্চে কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৭ শতাংশ। সম্প্রতি খাদ্য বহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা অস্থিতিশীল হলেও তা সহনীয় পর্যায়ে আছে।চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে কোন ঋণ নেয়নি। বরং ২৫ মার্চ পর্যন্ত ১০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা সরকার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর যোহানেস জাট বলেন, বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা, পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।তিনি বলেন, বাংলাদেশ মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল(এমডিজি) লক্ষ্য পূরণে ভাল করেছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সংস্কার কাছে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। নতুন ব্রিকস ব্যাংক এবং এআইবি ব্যাংকে যোগ দেওয়ায় এ বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখবে।এক প্রশ্নের উত্তরে জাট বলেন, বাজেট সাপোর্ট পেতে হলে সরকারকে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। সেই শর্তেই সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে।সাংবাদিকদরা জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ঘাটতি অর্থায়নের কোনো সমস্যা হয়নি। রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, বহির্বাণিজ্যে কিছুটা স্বস্তি আছে।